প্রতিভার সদ্ব্যবহার:
প্রতিভা। জিনিয়াস। মাওহিবাহ। এ সবকিছু তারুণ্যের এক পরম আরাধ্য। সুন্দর চেহারা বা সুন্দর কণ্ঠের মতোই প্রতিভা জিনিসটাও গড-গিফ্টেড—আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহর ভাষায়— এ কেবল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহমাত্র। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন কেবল তাকেই দান করেন। আর আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহশীল।¹
আল্লাহর দেওয়া প্রতিভা নামক আমানত তাই অপচয়ের অযোগ্য এক মহা নেয়ামত। আমরা যেমন আল্লাহর দেওয়া সুন্দর অবয়ব, সুললিত কণ্ঠ বা দৈহিক সৌষ্ঠব অপচয় কিংবা অপাত্রে ব্যবহার করতে পারি না। তেমনি প্রতিভার অপচয় বা যত্রতত্র ব্যবহারও আমাদের জন্য সমীচীন নয়। কারণ এ প্রতিভা তো আমার স্বয়ংউৎপাদিত কোনো সম্পদ নয়। বরং এ স্রেফ আল্লাহর দান ও বিশেষ অনুকম্পা আমার প্রতি। যদি বৈষয়িক সম্পদের অপচয় করলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হয়; তবে প্রতিভা নামক সম্পদের অপচয় করলেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
আল্লাহর দেওয়া প্রতিভার অপচয় ও অপমৃত্যু শুধু একটি বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করে তা নয়। বরং একেকটি প্রতিভার অপচয় গোটা মানবজাতির জন্য বয়ে আনে এক অপূরণীয় ক্ষতির দুঃস্বপ্ন। আজকের মানবসভ্যতার শিক্ষা, নৈতিকতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ আমরা পরিলক্ষণ করছি। তা কি এমনিতেই হয়েছে। যদি মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা তাঁদের অমূল্য প্রতিভার কদর না করতেন। যদি তাঁরা প্রতিভার সদ্ব্যবহার না করতেন। তাহলে আজকের মানবসভ্যতা ঠিক কোথায় পড়ে থাকতো তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
ইসলামের মহান মুজতাহিদ ইমামগণ যদি তাঁদের প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশে সচেষ্ট না হতেন, তাহলে সমগ্র উম্মাহর কী অপূরণীয় ক্ষতিই না সাধিত হতো! সমগ্র জাতি এবং বিশ্বমানবতা তাঁদের সুমহান অবদান থেকে বঞ্চিত হতো। এখন হয়তো আপনি বলবেন, ইচ্ছে করলেই তো আর ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাসির, যাহাবী, সাইয়েদ কুতুব, আল্লামা ইকবালদের মতো হওয়া যায় না। হাঁ, ইচ্ছে করলেই যদি তাদের মতো হওয়া যেতো, তাহলে তো অনেকেই হয়ে যেতেন। এ কথা সত্য যে, আল্লাহ কিছু মানুষকে মানবসভ্যতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিশেষ যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আপনাকে কোনো যোগ্যতাই দেননি— আপনার এ বদ্ধমূল বিশ্বাসের ভিত্তি কী? প্রকৃত সত্য হলো—আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষকেই কিছু না কিছু মেধা ও প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যা দিয়ে সে জীবন ও জগতের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। আর এজন্যই সবাইকে পরম আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ মেধা ও প্রতিভার বিকাশসাধনে সচেষ্ট হওয়া উচিত। অন্যথায় ব্যক্তি ও উম্মাহর অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হবে।
আমরা অন্যায়ভাবে পশু, পাখি ও জীবজন্তু হত্যা অপরাধ বলে বিশ্বাস করি। কেউ অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করলে দুনিয়ার আদালতে জবাবদিহি করতে হয়। হত্যাকারীর শাস্তির দাবিতে মিছিল-সমাবেশ হয়। সাক্ষ্য প্রমাণে দোষী সাব্যস্ত হলে হত্যাকারী সাজা পায়। অন্যায়ভাবে কোনো প্রাণী হত্যা করা নিঃসন্দেহে মারাত্মক অপরাধ। তবে একইসাথে মেধা হত্যাও বড় ধরনের অপরাধ। কেননা মেধা কারো ব্যক্তিগত সৃষ্টি নয়। প্রাণ যেমনিভাবে আল্লাহর দান; মেধাও আল্লাহর এক অপার দান। আল্লাহ যাদেরকে বুদ্ধি বিবেক দান করেন নি, তাদেরকে আমরা পাগল বলি। আল্লাহ ইচ্ছে করলে আমাকে বা আপনাকেও পাগল বানাতে পারতেন। তিনি অনুগ্রহ করে আমাদেরকে বুদ্ধি বিবেক দিয়েছেন। তাই আল্লাহ প্রদত্ত বুদ্ধি-বিবেক যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, অনেকেই প্রতিভা কাজে না লাগিয়ে প্রতিভা নষ্ট করেন। যারা এভাবে প্রতিভা নষ্ট করেন তারা শুধু ‘প্রতিভা নষ্টকারী নয়—তারা মেধা হত্যাকারী।’ মেধা হত্যাকারীরা দুনিয়ার আদালতে জিজ্ঞাসিত না হলেও আল্লাহ তাআলার আদালতে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে।
এ কথা আমাদের মানসপটে খোদাই করে নিতে হবে যে, প্রতিভা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিয়ামত। দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং উম্মাহর প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মেধাসম্পদ দান করেছেন। মানুষ কোন কাজে তার প্রতিভা ব্যবহার করেছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। এ বিষয়ে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘এরপর সেদিন অবশ্যই তোমরা নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।²
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হাত-পা, চোখ-কান-নাকসহ কী সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আলো, বাতাস, পানিসহ
কতো কিছুই দিয়েছেন। পাহাড়-পর্বত, বন-বনানী, গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি, পশু-পাখি সবই আল্লাহ তাআলার নিয়ামত। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যদি আমাদের মেধা দান না করতেন, তাহলে এসব কিছুই মানব কল্যাণে ব্যবহার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। এ কারণে মেধা আল্লাহর বিরাট নিয়ামত। দুনিয়ার অন্য বস্তুর মতো প্রতিভা সম্পর্কেও আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাই আল্লাহ তাআলা আমাদের যাকে যে ধরনের প্রতিভা দান করেছেন তা কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সর্বদা সচেষ্ট হওয়া উচিত।
এ কথা সত্য যে, আল্লাহ তাআলা সবাইকে সমান প্রতিভা দান করেন নি। অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ আছেন, যারা প্রধানমন্ত্রী হয়ে মানুষকে সাহিত্য পুরস্কার, কৃতী সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদকও দিয়ে থাকেন। কিন্তু সাহিত্য রচনা করতে বলা হলে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিলে সাহিত্যচর্চা কিংবা শিক্ষকতা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। অথচ রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্ব যোগ্যতার সাথে পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা তাকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে পুরস্কার প্রদানের যোগ্যতা দান করেছেন বটে; কিন্তু কবি-সাহিত্যিক হয়ে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা দান করেন নি। অনুরূপভাবে অনেক ঐতিহাসিক আছেন যারা রাজা বাদশাহদের দোষত্রুটির বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করে ইতিহাস লেখেন। কিন্তু তার পক্ষে রাষ্ট্রপরিচালনা সম্ভব নয়। একজন ব্যক্তি ঐতিহাসিক, লেখক, কলামিস্ট হিসেবে মানুষের আস্থাশীল হতে পারেন কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে তার উপর মানুষের আস্থা নাও থাকতে পারে। এভাবে প্রত্যেক মানুষের যোগ্যতা মূল্যায়ন করলে দেখা যায় আল্লাহ তাআলা সকলকে সমান প্রতিভা দান করেন নি।
ইতঃপূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা সবাইকে সমান যোগ্যতা দান করেন নি। তবে কিছু মানুষ আছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী: বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি, বক্তৃতা, লেখনী, শিল্প, সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো যোগ্যতা আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দান করেছেন। আবার কেউ কেউ আছেন শুধুমাত্র কোনো একটা বিশেষ ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো যোগ্যতা রাখেন। যেমন কোনো কোনো ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করতে পারে না কিন্তু সাংস্কৃতিক অঙ্গন বা সাংবাদিকতায় ভালো করতে পারে। আবার কেউ মানুষের সাথে ভালো মিশতে পারেন। মানে ভালো সংগঠক। কিন্তু দুই এক লাইন লেখার যোগ্যতা নেই। আবার কেউ আছেন পড়াশোনায় ভালো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা কিংবা বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যাবার মতো প্রতিভা আছে। কিন্তু কারো সামনে কিছু বলার যোগ্যতা নেই। আবার কেউ আছেন উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরও বেশি অবদান রাখার মতো যোগ্যতা আছে, কিন্তু মানুষের সাথে মেশার যোগ্যতা নেই। এই যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বহু ধরনের মানুষ রয়েছে তাদের সবার প্রতিভার যথাযথ বিকাশের ওপরই সমাজের সর্বজনীন উন্নয়ন নির্ভরশীল। তাই ব্যক্তি, জাতি ও মানবতার কল্যাণেই আমাদের প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে।
পাদটীকা :1. সুরাহ আল হাদীদ, আয়াত ১৬
2. সুরাহ আত-তাকাসুর, আয়াত ০৮