শহিদ সাইয়্যেদ কুতুব (রহি.) (১৯০৬-১৯৬৬) জাতিগতভাবে একজন মিসরীয় প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ ও ইসলামি আন্দোলনের নেতা। ঈমানী জজবা ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে ১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন মিসরীয় সরকার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে তাকে শহীদ করে দেয়।
গত শতাব্দীতে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হলেও বিংশ-শতাব্দীতে এসেও বিশ্বব্যাপী ইসলামি আন্দোলনগুলোর মাঝে রয়েছে তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব ও বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া। তাকে ইসলামি পুনর্জাগরণের অগ্রপথিক ও বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন তাত্ত্বিক রাহবার মনে করা হয়। বিশ্বব্যাপী ইসলামি আন্দোলন ও রাজনীতির বিশ্লেষণে সাইয়েদ কুতুবের নাম এখনও সমৃদ্ধ।
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা:
মিশর সহ ইসলামি বিশ্বে যখন একটি হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছে, ঠিক তখনই সাইয়্যেদ কুতুব ১৯০৬ সালে মিশরীয় শহর উসিউতে একটি সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজি ইব্রাহিম কুতুব কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন, তিনি কিছু পণ্য বিক্রি করতেন এবং কিছু তার অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সাথে ভাগ করে নিতেন।
অন্যদিকে তাঁর মা ছিলেন একটি ধার্মিক ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। তিনি সাইয়্যেদ কুতুবকে তাঁর অনুশাসন, ভালবাসা এবং মমতা দিয়ে প্রভাবিত করেছিলেন। সাইয়্যেদ কুতুবের দুই বোন এবং এক ভাই ছিলো। শৈশবেই তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ্ করেন এবং ১৯ বছর বয়সে তিনি আল-আজহারে মাধ্যমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করেন। এরপর তিনি ১৯২৮ সালে কায়রোর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূমে ভর্তি হন। আর কায়রোতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি যখন পিতাকে হারান, তখন তাঁর মা ও ভাই-বোনের সকল দায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়ে। এই অগ্নিপরীক্ষা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে, তিনি তাঁর মাকে কায়রো চলে আসতে রাজি করান এবং তারা কায়রো চলে আসেন।
এরই মাঝে ১৯৩৩ সালে সাহিত্য ও শিক্ষার উপর তিনি স্নাতক হন। আর ঐবছরই তিনি দারুল উলূমের প্রভাষক হিসাবে নিযুক্ত হন। এরমধ্যেই তিনি মিশরের শিক্ষা মন্ত্রণায়ে কাজ করার সুযোগ পান, যেই দায়িত্বে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছিলেন। আর ১৯৩৯ সাল থেকে তাঁর চিন্তাধারায় ব্যপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে, যা তাকে পরবর্তী সময়ে ইসলামী চিন্তাধারায় ফিরে আসতে বাধ্য করে।
এরপর ১৯৪০ সালে মায়ের আকস্মিক মৃত্যু সাইয়্যেদ কুতুবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এসময় জীবনে নিজেকে একা মনে হতে লাগে তাঁর। তিনি নিজেই এই বিষয়ে তাঁর অনুভূতি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর কয়েকটি বইয়ে।
মিশরের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইয়্যেদ কুতুব:
দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে থাকা অবস্থায় তিনি একজন প্রথম সারির সাহিত্যিক, সমালোচক, বুদ্বিজীবি এবং একজন কবি হিসেবে নিজের কাজের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন। একই সময় তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও জার্নালে প্রকাশিত নিজের লিখনীতে মিশরীয় রাজতন্ত্র, সামাজিক অবক্ষয় ও ইংরেজদের প্রভাবের কঠিন সমালোচনা করেন। আর ১৯৪৬ সালে তিনি বিভিন্ন নিবন্ধনে নিজের অবস্থান ও চিন্তাধারা প্রকাশ করতে শুরু করেন, যেগুলো তাকে ধীরে ধীরে ইসলামী চিন্তাধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করে। সাইয়্যেদ কুতুবের মাঝে এমন পরিবর্তন শুরু হওয়ার আগে তিনি ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সেক্যুলার ওয়াফদ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই দলের সাথে সময় কাটানোর পর তিনি প্রচলিত সেক্যুলার রাজনীতির বিষয়ে ধারণা লাভ করেন এবং এগুলো থেকে তাঁর মোহমুক্তি ঘটে। আর এরপরই শুরু হয় ইসলামি আঙ্গিনায় তাঁর নতুন পথচলা এবং ইসলামি দাওয়ার উপর তাঁর গবেষণা।
সাইয়্যেদ কুতুব কিন্তু তখন দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারী ছিলেন না। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি সামাজিক অবক্ষয় রোধে সমাধানের বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং তিনি যে পরিবেশে ছিলেন তা পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর এসব প্রস্তাবনা, পরিবর্তনের চেষ্টা ও সরকারবিরোধী লিখনী অনেককে তখন বিরক্ত করে তুলেছিল। আর এতেই শুরু হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাঁকে নিয়ে জটিলতা। সেই সাথে মিশরের রাজনীতিতে শুরু হয় উত্তপ্ততা।
সফরের নামে সাইয়্যেদ কুতুবকে দেশান্তরকরণ:
১৯৪৮ সাল থেকে সাইয়্যেদ কুতুবের লেখা ও চিন্তাধারায় আরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এসময় তাঁর লিখনীতে প্রাধান্য পায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জাগরণের স্বপ্ন। যেসব লিখনীর মাধ্যমে তিনি কুরআনের আলোকে কথিত আধুনিক সভ্যতার নোংরামি তুলে ধরেন, প্রচার করেন ইসলামি
সমাজ ও জীবনব্যবস্থার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা।
তাঁর মাঝে এমন পরিবর্তন এবং সামজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে পরিবর্তনের তার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তখন যাদেরকে বিরক্ত করে তুলেছিল, তারা তাকে দেশান্তর করার দাবি তুলে। আর এই কারণে, ১৯৪৯ সালে প্রশিক্ষণ সফরের নামে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একই সাথে তৎকালীন উত্তপ্ত মিশরের রাজনীতি থেকেও তাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এই সময়কালে সাইয়্যেদ কুতুব প্রত্যক্ষ করেন, পশ্চিমা ও সেক্যুলার জীবনধারা, বর্ণবাদ ও কথিত আধুনিক সভ্যতাকে। আর এটি তাঁর সামনে বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলে।
১৯৪৯ সালে, তিনি অ্যামেরিকায় থাকাকালীন, তাঁর লেখা “ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার” প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি মানুষের সামনে এটাই স্পষ্ট করার চেষ্টা করেন যে প্রকৃত সামাজিক ন্যায়বিচার ইসলামেই রয়েছে।তবে তখনো পর্যন্ত তার ইসলামী মানসগঠনের প্রক্রিয়া চলমান ছিল,ইসলামী চেতনার উপলধ্বি তার মাঝে জাগ্রত হতে শুরু করলেও তখনো পর্যন্ত তা পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠেনি।ফলে এই বইটিতে বেশ বড় ধরনের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে যায়।
তাঁর ছোট ভাই মুহাম্মাদ কুতুবের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৫৮ সালের পরবর্তী রচনাগুলোই সাইয়্যেদ কুতুবের সর্বশেষ অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে।
এছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটানো বছরগুলিতে, তিনি আগে যে সাহিত্যিক নিবন্ধ এবং রচনাগুলি লিখেছিলেন তার আত্মসমালোচনা করেন। সেই সাথে তাঁর বইগুলিতে, তিনি সমাজে ইসলামের প্রথাগত উপলব্ধির বিরুদ্ধে ইসলামের শরিয়ার প্রধান উৎস কোরান ও সুন্নাহর একটি অবস্থান তৈরি করেন। একই সাথে তিনি সুফিবাদের আড়ালে ইসলামের সাথে অন্যায় ও দুর্নীতিগুলোর বাস্তবিক সমালোচনা করেন।
এরপর ১৯৫০ সালে সাইয়্যেদ কুতুব (রহি.) দেশে ফিরে এসে যখন দেখলেন, এই শিক্ষা মন্ত্রালয় পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি মন্ত্রণায়ের উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
মিশরে সামরিক অভ্যুত্থান:
সাম্প্রতিক ইতিহাসে মিশরের সবচাইতে প্রভাবশালী ইসলামি আন্দোলনের নাম হচ্ছে ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রদারহুড। দেশে ইসলামি শরিয়াহ্ বাস্তবায়ন করতে ১৯৪০ সাল থেকেই এই দলটি সরকার পতনের জন্য সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ শুরু করে। আর এই লক্ষ্যে তারা মিশরীয় সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং সরকারের পতনের গোপন পরিকল্পনা তৈরি করে। এসব সামরিক বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে জামাল আব্দুন নাসের ছিলো অন্যতম।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম ব্রাদারহুড সেনা কর্মকর্তাদের সহায়তায় সামরিক উভ্যুত্থান ঘটান, পতন ঘটে মিশরের তৎকালীন বাদশা ফারুকের। মিশরের ক্ষমতায় আসে জামাল আব্দুন নাসের ও সেনা কর্মকর্তারা, যারা অভ্যুত্থানের আগে ইখওয়ানের পাশাপাশি সাইয়্যেদ কুতুবের সাথেও ভালো সম্পর্ক রাখে এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে থাকে।
তাই ইখওয়ান ও সাইয়্যেদ কুতুব ভাবেন যে, ক্ষমতার পালাবদলে এবার হয়তো শরিয়াহ্ ব্যবস্থা জারি করা হবে। কিন্তু ঘটে ঠিক বিপরীত; ক্ষমতায় আসা নাসেরের বাহিনী ইখওয়ানকে দমন করতে শুরু করে। আর সাইয়্যেদ কুতুব যেহেতু তখনো ইখওয়ানে যুক্ত হননি, তাই তার উপর তখনও এই চাপ আসেনি। তবে মিশরীয়দের কাছে কুতুবের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার ফলে সামরিক সরকার ইখওয়ানের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড় করাতে মরিয়া হয়ে উঠে। এই লক্ষ্য সরকার তাকে শিক্ষা ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি নিজ পছন্দ মতো যেকোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু সাইয়্যেদ কুতুব (রহি.) সামরিক সরকারের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সমস্ত প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এর মধ্য দিয়ে নাসের ও সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে সাইয়্যেদ কুতুবের। এর কিছুদিন পরেই তিনি তৎকালীন অগণতান্ত্রিক ইসলামি দল ইখওয়ানুল মুসলিমিনে যোগদান করেন। এ সময় তাকে বৃহৎ এই ইসলামি আন্দোলনটির দাওয়াহ ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান করা হয়। আর যোগ্যতার ফলে তিনি হয়ে উঠেন দলের উচ্চপদস্থ ও অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা।
এই সময়টাতে ক্রমাগত ইখওয়ানের সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন থেকে তিনি তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশ করার চেষ্টা করছিলেন।
কারাগারে সাইয়্যেদ কুতুব:
১৯৫৪-এর ২৬ অক্টোবর আলেকজান্দ্রিয়ার মানশিয়া নামক এলাকায় বক্তব্যকালে জামাল আব্দুন নাসেরের উপর আক্রমণের চেষ্টা করা হয়। এই ব্যর্থ আক্রমণের দায়ভার চাপানো হয় ব্রাদারহুডের উপর। আর এই হত্যাচেষ্টার অজুহাত দেখিয়ে মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই অযুহাতে বন্দী করা হয় শায়েখ সাইয়্যেদ কুতুব (রহি.) সহ ইখওয়ানের অনেক নেতা এবং অসংখ্য সাধারণ কর্মীকে। তারপর কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় তাদের সকলকে।
কারাগারে ভয়াবহ নির্যাতন তখন নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস হয়ে উঠে, আর এতে করে সাইয়্যেদ কুতুবের (রহি.) পেট এবং অন্ত্রে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। এসব নির্যাতনের ফলে এমনকি অনেকে শাহাদাত বরণ করেন।
ভয়াবহ এই নির্যাতনের কথা ছড়িয়ে পড়ে দেশি বিদেশি পত্রিকায়, ফলে সাইয়্যেদ কুতুব সহ অন্যান্য বন্দীদের দেখতে মিশরে আসে মানবাধিকার কর্মীরা। তখন কিছুদিনের জন্য তাঁর উপর নির্যাতন স্থগিত করা হয়, যাতে মানবাধিকার কর্মীরা সাইয়্যেদ কুতুবের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখতে না পায়। এদিকে মানবাধিকার প্রতিনিধিরা মিশর ছেড়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর সাইয়্যেদ কুতুবকে ফের বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এসময় সরকার তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া ও নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করার শর্তে তাকে মুক্তির প্রস্তাব দেয়, কিন্তু তিনি এধরণের সকল প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন; অপমানজনক শর্ত মেনে মুক্তিলাভের উপর তিনি বন্দীত্বকেই বেছে নেন। আর দীর্ঘ এই বন্দীত্বের সময়টাতেই তিনি একে একে তাঁর ঐতিহাসিক রচনাগুলো লিখতে থাকেন, যেগুলোর ফলে পুরো আরব বিশ্বে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
দশ বছর কারাগারে থাকার পর, ১৯৬৪ সালে তাঁর স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটলে তৎকালীন ইরাকি রাষ্ট্রপতি আরিফ আবদুস সালামের অনুরোধে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তাকে বাধ্যতামূলক নিজ বাড়িতে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়। আর এসময় তিনি লিখেন তাঁর যুগান্তকারী রচনা “মাআলিম ফিত তারিক”, যেটি আগামী বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নামে বাংলায় অনুবাদ করা হয়। তাঁর লিখিত এই বই ইসলামি আন্দোলনের চিন্তার জগতে এক বিপ্লব তৈরি করে। শুধু তাই নয়, ১৯৫৮ সালের পর থেকে তিনি যেই রচনাগুলো লিখেছেন, যেই চিন্তাধারা প্রচার করেছেন, তা-ই মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বহু প্রতিরোধ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। আর তাঁর ছোট ভাই মুহাম্মাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৫৮ সালের পরবর্তী রচনাগুলোই সাইয়্যেদ কুতুবের সর্বশেষ অবস্থানের প্রতিফলন করে।
ঈমানী দৃঢ়তায় বলিয়ান এক নক্ষত্রের চিরবিদায়:
১৯৬৫ সালে সাইয়্যেদ কুতুবের বিরুদ্ধে সরকার পতনের চক্রান্তের অভিযোগ এনে তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। তখন প্রমাণ হিসেব উপস্থাপন করা হয় “মাআলিম ফিত তারীক বা সাইনস অন দ্য রোড” বইটিকে। পরবর্তী সময়ে ইখওয়ান এই বইয়ের সাথে নিজেদের মুক্ত ঘোষণা করে।
এই সময় তাঁর বয়স ছিলো ৬০ বছর, সেই সাথে বেশ কয়েকটি রোগেও আক্রান্ত হন তিনি। তা সত্ত্বেও মিশরীয় কারাগারে তাঁর উপর নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়। শাসকগোষ্ঠী শুধু তাঁর উপর শারীরিক নির্যাতন করেই হয়নি, বরং তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের উপরও নির্যাতন চালাতে থাকে।
অবশেষে দেশটির সামরিক আদালত সাইয়্যেদ কুতুবের (রহি.) ফাঁসির আদেশ দেয়। তাঁর মুক্তির জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও আলেমগণ তখন সরকারের কাছে আবেদন জানায়। তখন সরকারের সাথে আপস করার শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু কুতুব তাঁর আদর্শ ও অবস্থান থেকে বিন্দু পরিমাণ সরে আসতে অস্বীকৃতি জানান।
তাঁর বোন হামিদার মাধ্যমেও সরকার একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, যার সারমর্ম ছিলো: “আপনি যদি রাষ্ট্রপতি জামাল আব্দুন নাসেরের কাছে ক্ষমা চান, এবং একথা বলেন যে, আপনি নিজ কথা ও কাজে ভুল ছিলেন, তাহলে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে।”
এসময় কুতুবের উত্তর স্পষ্ট ছিল: “যদি আমি মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হই তবে অধিকারের আদেশের উপর আপত্তি করা অন্যায়। আমি যদি মিথ্যা ও জুলুমের শিকার হই, তবে আমি মিথ্যার কাছে করুণা চাওয়ার পর্যায়ে যেতে পারি না।”
সবশেষ, ১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট ফজরের সময় শেখ আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল এবং মোহাম্মদ ইউসুফ সহ সাইয়্যেদ কুতুবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ফাঁসির আগে তিনি বলেছেন, ‘রক্তে সিঞ্চিত না হলে কোনো চেতনার স্থায়িত্ব আসে না।’ তিনি যেনো তাঁর জীবন দিয়ে তাই প্রমান করে গছেন। সামরিক শাসন তাঁকে ফাঁসি দিয়ে তাঁর দেহ বিদায় করেছে ঠিকই, কিন্তু হাজার বছরের জন্য তাঁর রেখে যাওয়া চেতনায় প্রাণ সঞ্চার করেছে।
সাইয়্যেদ কুতুবএর (রহি.) মৃত্যুদণ্ডের ঠিক আগে আগে একটি ঘটনা ঘটে, যে ঘটনাটি দেশে দেশে যুগে যুগে মানুষের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে; যে ঘটনা নিয়ে কবিরা রচনা করেছেন অনেক কবিতা।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে তাঁকে কালিমা পড়াতে একজন শাইখকে পাঠানো হয় জেলখানায়। তখন সাইয়্যেদ কুতুব (রহি.) তাকে লক্ষ করে বলেছিলেন, “অবশেষে আপনি এলেন এই নাটকের অবসান ঘটাতে? মনে রাখবেন, আমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর কালিমাকে বিজয়ী করতে চাচ্ছি বলে আমাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে। আর আপনারা এই কালিমা বিক্রি করে খাচ্ছেন। শুনে নিন, আমি বলছি—আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর, ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।”