মানসিক প্রশান্তি লাভের উপায়:
আল্লাহ তাআলা আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের ভেতরে এক অদৃশ্য আত্মা দিয়েছেন। এই আত্মা আর মনের মাঝে নানা সময় নানা কিছু বিরাজ করে। কখনো আনন্দ অনুভব হয়, কখনো খুবই সংকীর্ণ আর কষ্ট অনুভব হয়, যা কাউকে ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো যায় না। মনটা একদম সংকীর্ণ হয়ে যায়। কেন যেন অজানা কোনো কারণে মনটা চিন্তিত আর পেরেশান থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় বুকের মাঝে জগদ্দল পাথর আটকে রয়েছে। শয়তানও এর মাঝে এই পালে হাওয়া দিতে থাকে। এজন্য আমরা এখানে মানুষের মন, বক্ষ প্রশস্ত ও প্রফুল্ল থাকার কিছু কারণ বর্ণনা করবো— ইন শা আল্লাহ।
এক. আল্লাহতে বিশ্বাসী হওয়া। আল্লাহর পরিচয়, আল্লাহর ভালোবাসা, আল্লাহর স্মরণ মানুষের মনকে প্রশান্তি দান করে স্থিরতা দান করে। তার প্রতি তাওয়াক্কুল পূর্ণ বিশ্বাস, নিজেকে পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দেওয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। মানুষের বিশ্বাস আর সমর্পণ অনুযায়ী তার মনের মাঝে শান্তি বিরাজ করে থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَفَمَنۡ شَرَحَ اللّٰہُ صَدۡرَہٗ لِلۡاِسۡلَامِ فَہُوَ عَلٰی نُوۡرٍ مِّنۡ رَّبِّہٖ ؕ فَوَیۡلٌ لِّلۡقٰسِیَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ مِّنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ؕ اُولٰٓئِکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন ফলে সে তার রবের দেয়া জ্যোতির উপর রয়েছে, সে কি তার সমান যে এরূপ নয়? অতএব দুর্ভোগ সে কঠোর হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য, যারা আল্লাহর স্মরণ বিমুখ! তারা স্পষ্ট বিভ্ৰান্তিতে আছে। —সুরাহ আয-যুমার, আয়াত ২২
হাদিসে এসেছে, যখন কলবে নুর প্রবেশ করে, তখন সে কলব প্রশস্ত হয়ে যায়।
দুই. দ্বিনি ইলম। ইলমের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বক্ষকে উন্মোচিত করেন, প্রশস্ত করে দেন। তখন হৃদয়টা পুরো পৃথিবী থেকে আরো প্রশস্ত হয়ে যায়। আর মূর্খতা, ভ্রষ্টতা অন্তরকে সংকীর্ণ করে দেয়। বান্দার ইলম যত বিস্তৃত ও ব্যাপক হবে, তার হৃদয় তত প্রশস্ত হতে থাকবে। তাই প্রকৃত ইলমের অধিকারীরাই সবচেয়ে প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী।
তিন. আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে ভালো ধারণা রাখা। আল্লাহ তাআলা সব দুশ্চিন্তা ও পেরেশানিকে দূর করতে সক্ষম। এবং তিনি প্রকৃতপক্ষে এসব দূর করে থাকেন। বান্দার ধারণা আল্লাহর প্রতি যত পাকাপোক্ত হবে, তার অন্তর আল্লাহ তাআলা সেরকম করে দেবেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার জন্য বরকত নাযিল করবেন। আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ বলেন, আমার সম্পর্কে আমার বান্দার ধারণার মতো ব্যবহার করে থাকি। সে ভালো ধারণা করলে ভালো, আর মন্দ ধারণা করলে মন্দই হয়ে থাকে। —সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৬৩৯
চার. আল্লাহর কাছে নিজেকে পূর্ণরূপে সঁপে দেওয়া। যেকোনো কাজকর্মে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখা। তিনি সব কিছুর অধিকারী। এ জন্য সর্বদা তাঁর বিধানমতো চলা।
আল্লাহ বলেন, (অনুবাদ) যে ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় সৎকর্ম করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, আমি অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন যাপন করাব এবং তাদেরকে তাদের উত্কৃষ্ট কর্ম অনুযায়ী তাদের প্রতিদান অবশ্যই প্রদান করব। —সুরাহ আন-নাহল, আয়াত ৯৭
তাই যে ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহর বিধান মতো চলবে, মাঝে মাঝে তার মনে হবে, সে দুনিয়াতে থেকেই জান্নাতের অনাবিল সুখ লাভ করছে।
এ কারণেই যার সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আল্লাহ তাআলা তার জীবনকে সংকীর্ণ করে দেন। সে কথাও আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারিমে বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে ওঠাব। —সুরাহ তহা, আয়াত ১২৪
আল্লাহর স্মরণবিহীন দুনিয়াটা একটুকরা জাহান্নামে পরিণত হবে তার জন্য। এ জন্য নিজেকে সর্বদা যেকোনো ধরনের জিকিরে অভ্যস্ত রাখা। এর প্রশান্তি একমাত্র জিকিরকারীরা অনুভব করতে পারে।
পাঁচ. মানুষের কল্যাণে কাজ করা। সাধ্য অনুযায়ী অর্থ ও সামর্থ্য দিয়ে মানুষকে উপকার করা। যারা প্রতিনিয়ত মানুষের উপকার করে, তারা অনুভব করে যে এতে অন্য রকম এক প্রশান্তি রয়েছে। এক হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদি. বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কৃপণ ও দানশীলদের উদাহরণ হচ্ছে এমন দুই ব্যক্তির মতো, যাদের পরনে দুুটো লৌহবর্ম রয়েছে। অতঃপর দানশীল ব্যক্তি যখন দান করার ইচ্ছা করে তার বর্ম প্রশস্ত হয়ে যায়, এমনকি তার পায়ের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলতে থাকে। কিন্তু যখন কৃপণ ব্যক্তি দান করার ইচ্ছা করে তখন তা সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং তার হাত গলার সঙ্গে আটকে পড়ে, আর প্রতিটি গ্রন্থি অন্যটির সঙ্গে কষে যায়। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ—কে বলতে শুনেছি, তারপর সে তা প্রশস্ত করার চেষ্টা করে কিন্তু তা করতে সক্ষম হয় না। —সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২২৫১
ছয়. বীরত্ব ও সাহসিকতা। বীরত্ব মানুষের অন্তরকে প্রশস্ত রাখতে সহযোগিতা করে। আর ভীরুতা, কাপুরুষতা মানুষের অন্তরকে সংকীর্ণ করে দেয়। সে তার অন্তরে প্রশান্তি লাভ করে না। দুনিয়াতে সে শুধু প্রাণীদের মতোই স্বাদ অনুভব করে। কিন্তু আত্মিক শান্তি থেকে ভীরুরা সব সময় বঞ্চিত থাকে।
সাত. অহেতুক জিনিস বর্জন করা। অহেতুক কাজ, কথা, আলোচনা-সমালোচনা, অপ্রয়োজনীয় ঘুম, খাবারদাবার—এসব মানুষের অন্তরকে নষ্ট করে, সংকীর্ণ করে। বরং দুনিয়া ও আখিরাতের বেশির ভাগ শাস্তি হবে এই অহেতুক কাজের কারণে।
আট. ভালো লোকদের সাহচর্য গ্রহণ করা। তাদের কথা শোনা, তাদের জীবন থেকে উপকৃত হওয়া। ভালো মানুষের সাহচর্য আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কারণ। আপনি যখন কোনো ভালো মানুষের কাছে যাবেন, তখন আপনার অন্তরে অন্য রকম এক পুলক অনুভব করবেন। এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দান। কারণ ভালো মানুষের সাহচর্যবিশিষ্ট অন্তর থেকে শয়তান দূরে থাকে।
নয়. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা। কারণ কোরআন তিলাওয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর। যে বক্ষে কোরআন রয়েছে সেখানে শয়তান আসতে পারে না। ইবনু আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, যার হৃদয়ে কোরআনের কিছুই নেই সে বর্জিত ঘরের মতো। —জামে তিরমিযি, হাদিস নং ২৯১৩
আল্লাহ তাআলা বলেন, (অনুবাদ) “হে মানুষ! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে এক উপদেশ, অন্তরের রোগব্যাধির উপশম এবং মুমিনদের পক্ষে হিদায়াত ও রহমত।” —সুরাহ ইউনুস, আয়াত ৫৭
কুরআন সর্বরোগের নিরাময়, তা অন্তরের রোগই হোক কিংবা দেহেরই হোক। হাদিসের বর্ণনা ও উম্মাতের আলিম সম্প্রদায়ের অসংখ্য অভিজ্ঞতাই এটির প্রমাণ যে, কুরআন মজিদ যেমন আত্মার ব্যাধির জন্য অব্যর্থ মহৌষধ, তেমনি দৈহিক ব্যাধির জন্যও উত্তম চিকিৎসা।
দশ. বিবাহ করা।
পুরুষদের যত প্রয়োজন নারীর সাথে সম্পৃক্ত সবগুলো সম্পর্কে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, সবগুলোর সারমর্ম হচ্ছে মানসিক শান্তি ও সুখ। এজন্যই আল্লাহ তাআলা নারী জাতি সৃষ্টি করার রহস্য ও উপকারিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন,
وَ مِنۡ اٰیٰتِہٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡہَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ
আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া; যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং সৃজন করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও সহমর্মিতা। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে। —সুরাহ আর-রুম, আয়াত ২১
ইবন কাসির রাহি. বলেন, আয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহ তোমাদের স্বজাতি থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করেছেন। যাতে তোমাদের মধ্যে প্রশান্তি আসে। যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন,
ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ جَعَلَ مِنۡہَا زَوۡجَہَا لِیَسۡکُنَ اِلَیۡہَا
“তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।” —সুরাহ আল-আরাফ, আয়াত ১৮৯
প্রত্যেক জীব কেবল স্বজাতির কাছেই নৈকট্য লাভ করে ও শান্তি পায়; যা মানসিক প্রশান্তির জন্য একান্ত জরুরী। নৈকট্য বিনা তা সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক যে টান ও আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন; প্রকৃতির এই চাহিদা জোড়া সৃষ্টির মাধ্যমে পূরণ হয় এবং একে অপরের নৈকট্য ও ভালবাসা অর্জন করে। সুতরাং বাস্তবতা এই যে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে প্রেম-ভালবাসা দেখা যায়, তা পৃথিবীর আর কারো মাঝে দেখা যায় না। তার কাছে যেয়ে স্বামী যেই পরিমাণ প্রশান্তি লাভ করে, অন্য কোথাও সে সেই পরিমাণ প্রশান্তি লাভ করে না।