শরিআতের অপরিহার্যতা
মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করে এবং করতে বাধ্যও বটে। এজন্য তাদের এমন একটি বিধানের প্রয়োজন আবশ্যকীয়, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ নির্ণয় করবে, অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেবে। প্রত্যেকের স্বেচ্ছাচারিতাকে আইনের দ্বারা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করবে। এ ব্যবস্থা না হলে মানুষের সামষ্টিক জীবন দুষ্কর হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। কেননা মানুষ স্বভাবতঃই স্বার্থপর, আত্মপূজারী। নিজের সুবিধা ও স্বার্থকে বড় করে দেখা প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। সুতরাং এটা যদি বাঁধা-বন্ধনমুক্ত থাকে, আইনের ধারাবলে সুনিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে পারস্পরিক জুলুম-নির্যাতন-নিষ্পেষণ, অধিকার হরণ এবং সামাজিক বিপর্যয় হবে অনিবার্য পরিণতি রূপে। এমতাবস্থায় মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে এবং হতে বাধ্য। প্রতাপশালী ও ষড়যন্ত্রকারীরাই সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হবে। এ কারণে মানব প্রকৃতি এমন একটা ব্যবস্থা ও বিধান লাভের তীব্র প্রয়োজন অনুভব করেছে চিরকাল, যা সমাজক্ষেত্রে ব্যক্তির স্থান ও অধিকার চিহ্নিত ও নিশ্চয়তাপূর্ণ করবে, প্রত্যেকের জন্য কর্মসীমা নির্দিষ্ট করে দেবে ও অধিকার আদায়ের নিয়ম বেঁধে দেবে, যেন কেউ কারো অধিকার হরণ করতে না পারে, কেউই তার নিজের সীমা লংঘন করে অন্যের সীমার মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
বস্তুতঃ এরূপ একটা সুষ্ঠু, সর্বাত্মক ও সর্বব্যপক ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের সামাজিক জীবন সম্ভবপর হতে পারে না। একারণেই আল্লাহ তাআলার নাযিল করা শরিআতের বিধান তার অন্যান্য অগণিত অফুরন্ত নিআমতের ন্যায় বিশ্বমানবতার প্রতি এক বিরাট রহমাত হয়ে দেখা দিয়েছে। এর ভিত্তিতেই হতে পারে মানুষের যাবতীয় সমস্যার সার্থক সমাধান, তাদের পারস্পরিক বিরোধ-বিবাদের সুষ্ঠু মীমাংসা ও নিষ্পত্তি। উপরন্তু মানুষ যে পাঁচটি নিম্নতম প্রয়োজন পূরণের মুখাপেক্ষী, তার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানও এরই ভিত্তিতে সম্ভব। সে পাঁচটি জিনিস হচ্ছেঃ দ্বীন, প্রাণ, বংশ, ধন-মাল ও বিবেক-বুদ্ধির স্বাধীনতা সংরক্ষণ। কেননা এ পাঁচটি জিনিসের ভিত্তিতেই ব্যক্তি তার রবের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে এবং আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে পাওয়া জীবন ও রিজিক-এর যথার্থ কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারে। বস্তুতঃ আল্লাহ তাআলার শরিআতই হচ্ছে তার বান্দাদের পরস্পরে সুবিচার ও ন্যায়পরতা স্থাপনের যথার্থ বিধান, আপন সৃষ্টির প্রতি এটা তার বিরাট রহমাতের দান এবং মানবতার প্রতি এটা তার বিশেষ অনুগ্রহ। অন্যকথায়, পৃথিবীর উপর এটা তার ছায়া বিশেষ এবং সে ছায়া নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ব্যাপক, সর্বাত্মক ও নির্বিশেষ; পরম শান্তি ও স্বস্তির একমাত্র নিয়ামক।
আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে আপন জীবন সংগঠন ও উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপারে কেবলমাত্র তাদের নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল বা তারই মুখাপেক্ষী বানিয়ে ছেড়ে দেন নি; বরং তা থেকে তাদেরকে অনেকটা মুক্ত করেছেন শরিআতের এ বিধান উপস্থাপিত করে। কেননা মানব রচিত কোন বিধানই তাদের স্বেচ্ছাচার ও লালসা-কামনার প্রভাব থেকে মুক্ত ও পবিত্র নয়। তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র একমাত্র আল্লাহ তাআলার শরিআতের এই বিধান। কেননা আল্লাহ্ নিজেই এই বিধানের রচয়িতা, মানুষ কেবলমাত্র তারই সৃষ্টি। তিনি এ বিধান রচনা করেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, মানুষ তা নিজেদের জীবনে পালন করে চলবে। আল্লাহ তাআলা নিজে সব রকমের পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত ও পবিত্র। নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই তার বান্দাহ। এদিক দিয়ে সবাই তার নিকট সমান। কেউ তার আপন নয়, কেউ নয় পর। প্রত্যেকেরই অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা রয়েছে তার। সমগ্র সৃষ্টি লোকের প্রকৃত অবস্থা তার নিকট সুস্পষ্ট। কোন মানুষেরই এরূপ ব্যাপক ক্ষমতা ও যোগ্যতা থাকতে পারে না। কারো জ্ঞানই অতটা ব্যপক নয়। সকলের স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা একই সময় সমানভাবে কারো গোচরীভূত থাকা সম্ভব নয়। ফলে মানুষের রচিত বিধান খামখেয়ালী, স্বার্থপরতার ও পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হলেও তা কখনই ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসম্পূর্ণতা এবং ব্যক্তিগত হৃদয়াবেগ ও প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারে না। তা যদি হতো— তাহলে তাদের পরস্পরে এতো মতভেদ কখনই হতে পারত না। তারা যে কেবল বহু লোক একত্র হলেই মতবিরোধে লিপ্ত হয় তা—ই নয়; বরং এক ব্যক্তিও যদি বিধান রচনার জন্য দায়িত্বশীল হয়, তবুও সেই ব্যক্তির নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি ও রুচি-প্রবণতার মাঝে বিরোধ দেখা দেবে অনিবার্যভাবে। উপরন্তু মানুষ সব দিক চিন্তা-বিবেচনা করে আজ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, পরবর্তী দিন তা-ই বদলে দিতে বাধ্য হয়। কেননা পরবর্তীকালে চিন্তার এমন এক নতুন দিগন্ত তার নিকট উন্মুক্ত হয়ে যায়— সমস্যাটি এমন রূপ পরিগ্রহ করে, যা পূর্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে তার জীবন ও মানসলোকে কখনো বর্তমান ছিল না।