খতমে নবুওয়াতের পবিত্র বিশ্বাস ও কাদিয়ানী ফিতনার উদ্ভব:
মুহাম্মাদ ﷺ সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী; তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই
আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ ও পরকালে বিশ্বাস স্থাপনের পর ইসলামের সমগ্র অবকাঠামো যে সব মৌলিক ও বুনিয়াদি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলির অন্যতম ও শীর্ষস্থানীয় বিশ্বাসের নাম হলো ‘খতমে নবুওয়াতের আকীদাহ বা নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি ও চিরন্তনতা বিষয়ক বিশ্বাস। যার সরল অর্থ হলো, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমই হলেন সর্বশেষ ও চিরন্তন নবী। তাঁর পরে আর কোনো নবী হবে না। তাঁর মাধ্যমে নবুওয়াতের পবিত্র স্বর্ণধারার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। ভাষা, বর্ণ, কাল ও আঞ্চলিকতার সীমারেখা অতিক্রম করে তিনি সর্বযুগের, সর্বকালের ও সর্বজাতির জন্য চূড়ান্ত ও শাশ্বত নবী। তাঁর নবিত্ব অকাট্য। তাঁর চিরন্তনতা ও সার্বজনীনতা প্রশ্নাতীত। তাঁর বিদায়ের মধ্য দিয়ে নবুওয়াত ও রিসালাতের ধারা কিয়ামত পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার পরে না কেউ ওহী বা প্রত্যাদেশ লাভের দাবী করতে পারে, না কেউ এমন অন্তঃপ্রেরণা উপলব্ধির দাবী করতে পারে, যা শরীয়তে ইসলামিয়াতে দলিল হওয়ার যোগ্য হয়। কেউ যেমন সালাত, সিয়াম, হজ্জ বা যাকাত অস্বীকার করে মুসলিম থাকতে পারে না, তেমনি কেউ খতমে নবুওয়াতের আকীদাহ অস্বীকার করেও মুসলিম থাকতে পারে না। চাই খোল্লামখুলা অস্বীকার হোক কিংবা ইনিয়ে বিনিয়ে অপব্যাখ্যার আড়ালে অস্বীকার হোক।
কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে খতমে নবুওয়াতের প্রমাণ :
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; ববং তিনি আল্লাহর রসুল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” [সুরাহ আল আহযাব: ৩৩:৪০]
তাফসীর জগতের বরিত সম্রাট ইমাম ইবনু কাসির এ আয়াতের অধীনে বলেন, “আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে এবং রাসুল ﷺ পরম্পরাসূত্রে বর্ণিত অমীয় হাদীসের মাধ্যমে উম্মাতকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন যে, মুহাম্মাদ ﷺ এর পরে আর কোনো নবী আসবে না। উম্মাত যেন এ ব্যাপারে সতর্ক থাকে, রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পরে যে-ই নবুওয়াতের দাবী করবে সেই মিথ্যুক, প্রতারক ও ধোঁকাবাজ। যে নিজেও পথভ্রষ্ট এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে”। [তাফসিরে ইবনু কাসির ৩/৪৯৩]
আয়াতে উল্লিখিত “খাতামুন” শব্দের অর্থ মোহর। সর্বশেষ কর্মকেই মোহর বলা হয়। যেমন চিঠি লেখার সব আয়োজন সম্পন্ন হলেই তবে চিঠি মোহারাঙ্কিত করা হয়। তেমনি কোনো কিছুর নির্বিকল্প চিরন্তনতা বোঝাতে আরবীতে খাতামুন শব্দের ব্যবহার প্রচলিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“{হে নবী!}বলুন, হে মানুষ, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত রসূল।” [সুরাহ আল আরাফ ৭:১৫৮]
এ আয়াতের সবচেয়ে বড় প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, রসূলের প্রেরণ সর্বজনীন ও সর্বকালীন। রসূলের উপযোগিতা কিয়ামত অবধি অনুপেক্ষ। তাওহীদ ও একত্ববাদের চেতনা যেমন অবিভাজ্য, তেমনি রিসালাত ও মুহাম্মাদী বাহকত্বও অবিভাজ্য। আল্লাহর সত্তা ও গুণে যেমন অংশীবাদের স্থান নেই। তেমনি রসূলের রিসালাত ও নবুওয়াতেও কোনো ভাগাভাগি নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
আমি তো আপনাকে সমগ্ৰ মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সুরাহ সাবা ৩৪:২৮]
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“(হে নবী) আমি তো আপনাকে সমগ্র বিশ্বজিতের জন্যই রহমাতরূপে পাঠিয়েছি।”[সূরাহ আল-আম্বিয়া ২১:১০৭ ]
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়েও ঠিক একইরকম বার্তা ও আবেদন নিহিত আছে। রসূলের রিসালাতের সুব্যাপ্তি ও অবিচ্ছিন্নতা প্রতিভাত হয়েছে আয়াতের প্রতিটি হরফে ও বর্ণে।
এ বিষয়ে বিশ্বনবী’র বক্তব্য:
“আমি সাদা-কালো সব বর্ণের মানুষের কাছে প্রেরিত হয়েছি।” [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ২৭৪২, ২২৫৬]
“আমি সর্বদিগন্তের সর্বজাতির কাছে প্রেরিত হয়েছি। কিন্তু আমার পূর্বসূরী নবীগণ প্রেরিত হতেন নির্দিষ্ট কাল ও অঞ্চলের জন্য।” [মুসনাদে আহমাদ, ১৪২৬৪]
“তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলের পরস্পর সংলগ্নতা ও অবিচ্ছিন্নতা নির্দেশ করে তিনি বলেন,আমার আগমন ও কিয়ামতের অবস্থান হলো এরূপ।” [সহীহুল বুখারি, হাদিস নং ৪৯৩৬, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৮৬৭]
উপরোক্ত হাদীসগুলির দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হলো, রসূল হলেন কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানবপ্রজন্মের জন্য প্রেরিত নবী। তাঁর নবুওয়াত যেমন কোনো কালিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি সীমাবদ্ধ নয় কোনো আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক সীমারেখায়। তাঁর নবুওয়াতের পরিধি অখণ্ড ব্যাপ্ত ও সুবিস্তৃত।
“আমি এবং অন্যান্য নবীগণের দৃষ্টান্ত হলো ঐ ব্যক্তির মতো, যে একটি দৃষ্টিনন্দন সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করে কেন্দ্রীয় অংশে এক ইট পরিমাণ জায়গা খালি রেখে দেয়। প্রাসাদের নান্দনিকতায় দর্শনার্থীরা অভিভূত হতে থাকে। কিন্তু তারা আক্ষেপ করে বলতে থাকে, যদি ঐ অংশটুকু ভরাট করা হতো তাহলে সৌন্দর্য পূর্ণতা পেত! ঐ খালি জায়গাটুকু হলাম আমি। আমার দ্বারাই নবুওয়াত-প্রাসাদের নির্মাণযাত্রা সম্পন্ন হয়েছে। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২২৮৭; সহিহুল বুখারি, হাদিস নং ৩৫৩৪]
“আমাকে ছয়টি জিনিস দ্বারা অন্য নবীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে :
- আমাকে সর্বমর্মী বচনের অধিকারী করা হয়েছে।
- আমাকে সর্বসঞ্চারী প্রভাব দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে।
- আমার জন্য গনীমতের মাল হালাল করা হয়েছে।
- আমার জন্য মাটিকে পবিত্রতা ও সাজদার জায়গা করা হয়েছে।
- আমাকে সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে।
- আমার মাধ্যমে নবীদের আগমনধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫২৩]
ভণ্ড নবীর আবির্ভাব সম্বন্ধে রসূলের ভবিষ্যদ্বাণী :
“আমার উম্মতের মধ্য হতে ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর আত্মপ্রকাশ ঘটবে। তাদের প্রত্যেকে নিজেকে নবী বলে দাবি করবে। অথচ আমি খাতামুন নাবিয়্যিন, আমার পরে আর কোনো নবী নেই। [সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং ২২১৯; সুনানে ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ২৯৫২]
উল্লিখিত হাদীসগুলো খুব সহজ ভাষায় ও প্রাণবন্ত শৈলীতে রসূলের রিসালাতের অখণ্ডতা প্রমাণ করার পাশাপাশি যুগে যুগে ভণ্ড নবী দাবীদারদেরও মুখোশ উন্মোচন করেছে। যাতে করে অনাগত মানবপ্রজন্ম আলো আর আলেয়ার মাঝে, পানি ও মরীচিকার মাঝে সপারগ সঙ্কল্পে পার্থক্য রচনা করতে পারে। তারা যেন প্রতারিত না হয় কোনো প্রতারক, ঈমানের হন্তারকের কাছে।
কাদিয়ানী কারা?
কাদিয়ানী এক ব্যক্তির নাম। তার পুরো নাম গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই ব্যক্তির উত্থান ও আবির্ভাব। শোষক ইংরেজ রাজের আশীর্বাদ ও যোগসাজশে প্রতিবাদমুখর স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের মনোযোগ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে, সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদে মুসলিম জাতির মাঝে বিভ্রান্তির বীজ বুনতে এই লোক নবী হওয়ার দাবী করে। কিন্তু কুরআন হাদীসের কোনো সমর্থন তো ছিলোই না, অধিকন্তু তার ব্যক্তিজীবন ছিল মলিনতায় আচ্ছন্ন, পুঁতিগন্ধময়, আবিলতায় জর্জরিত ও অনৈতিকতায় ভরা। তার নামে তার অনুসারীদের কাদিয়ানী সম্প্রদায় বলা হয়।
কাদিয়ানীদের আকীদাহ
কাদিয়ানীদের বইপত্রের কাদিয়ানীকে যারা নবী হিসেবে স্বীকার করে না, তাদের কাফির আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাদের একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “হাকিকাতুন নুবুওয়াহ”তে বলা হয়েছে– “মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ঐ অর্থে নবী, যে অর্থে পূর্ববর্তী হযরত মুসা (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.) নবী ছিলেন। যেমনিভাবে কোনো একজন নবীকে অস্বীকারকারী কাফের, তেমনিভাবে মির্জা গোলাম আহমদের নবুওয়ত অস্বীকারকারীও কাফের।”
এভাবে কাদিয়ানী সমপ্রদায় নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে ধোঁকা ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে ইসলামের নামে একটি নতুন ধর্মমতের প্রচারণা চালিয়ে সমাজে অশান্তি ও অরাজকতা ছড়িয়ে যাচ্ছে নিরন্তরভাবে।
কাদিয়ানীদের ব্যাপারে মুসলিমবিশ্বের অবস্থান
প্রায় সব ক’টি মুসলিম দেশে কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের যাবতীয় বই-পুস্তক ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, ১৯৫৭ সালে সিরিয়া সরকার কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। কাদিয়ানীদের সংগঠনকে অবৈধ ও বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে। ১৯৫৮ সালে মিশর সরকার কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কাফির এবং তাদের সংগঠনকে বেআইনি সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে। ১৯৭৪ সাল মোতাবেক ১৩৯৪ হিজরির ১৪ রবিউল আউয়াল থেকে ১৮ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী ১০৪টি দেশের সম্মিলিত সংগঠন ‘রাবিততুল আলামিল ইসলামি’-এর অধিবেশনে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে–“এ দলটি কাফির ও ইসলাম বহির্ভূত। তাদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম এবং মুসলিমদের কবরস্থানে তাদের দাফন করা নাজায়েয।”
এই প্রস্তাবগুলি ১০৪টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে পাস করেছেন। তাদের মধ্যে সৌদিআরব, দুবাই, আবুধাবি, কাতারসহ বিভিন্ন দেশ অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সংসদও কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশে তাদের আজও অমুসলিম ঘোষণা করা হয়নি। যে কারণে বর্তমানে তারা এ দেশে প্রকাশ্যে উস্কানিমূলক অপতৎপরতা চালিয়ে যেতে পারছে।
আল্লাহ তাআলা এদের অনিষ্ট ও রাহুগ্রাস থেকে মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি জনপদ নিরাপদ রাখেন।
সাহাবীদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ ও আমাদের প্রেরণা
মুহাম্মাদ ﷺ এর ইন্তিকালের অব্যাবহিত পরই মুসাইলামা নাম্মী এক নবী দাবীদার আত্মপ্রকাশ করলে সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তাকে প্রতিহত করেন। এই দুর্ধর্ষ নেতৃত্বলোভী লোকটাকে প্রতিহত করতে বহু সাহাবীর জীবন দিতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে নবুওয়াতের স্বর্ণপ্রাসাদের ওপর যে কোনো নগ্ন হামলা নস্যাতের শপথ ব্যক্ত করেছিলেন। আজও সময় এসেছে মুসলিমদের নবীপ্রেমে উজ্জীবিত হবার। সাহাবায়ে কেরামের পদচিহ্ন অনুসরণ করে নবীর সম্মান রক্ষায় প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দেবার।