প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের সময় কিবলাকে সামনে বা পেছনে রাখা : নুসুসে শারিআহ কী বলে?

প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের সময় কিবলাকে সামনে বা পেছনে রাখা:

আমরা উল্লেখিত মাসয়ালার সমাধানের ব্যাপারে আলোচনার পূর্বেই মাসয়ালার সাথে সংশ্লিষ্ট নুসুস তথা হাদিসগুলো জানবো। অতঃপর হাদিসগুলো এবং আইম্মাদের মতামতের আলোকে আমরা সমাধান বের করব— ইনশাআল্লাহ।

১. আবু আইয়ুব আল আনসারি রাদি. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إذا أتيتُم الغائِطَ فلا تستقبِلوا القِبلةَ، ولا تَستَدبِروها ببولٍ ولا غائِطٍ، ولكِن شرِّقوا أو غَرِّبوا

তোমরা যখন পায়খানায় যাবে তখন কিবলাকে সামনে বা পেছনে রেখে বসবে না, বরং পূর্বদিকে ফিরে বসবে অথবা পশ্চিম দিকে। —সহিহুল বুখার, হাদিস নং ৩৯৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৪

শায়খ ইমাম মাহ্য়ুস সুন্নাহ রাহি. বলেছেন,

هَذَا الْحَدِيثُ فِي الصَّحْرَاءِ وَأَمَّا فِي الْبُنْيَانِ فَلَا بَأْس

এটা উন্মুক্ত প্রান্তরের হুকুম। বিল্ডিংয়ে বা ঘরের অবস্থিত পায়খানার ক্ষেত্রে অথবা ঘরের মতো করে নির্মিত পায়খানার ক্ষেত্রে এরূপ করা অর্থাৎ কিবলাকে সামনে বা পেছনে রেখে বসা দোষের নয়। —মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৩৩৪

২. আবদুল্লাহ ইবনু উমার রাদি. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

إِنَّ نَاسًا يَقُولُونَ إِذَا قَعَدْتَ عَلَى حَاجَتِكَ، فَلاَ تَسْتَقْبِلِ الْقِبْلَةَ وَلاَ بَيْتَ الْمَقْدِسِ‏.‏ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ لَقَدِ ارْتَقَيْتُ يَوْمًا عَلَى ظَهْرِ بَيْتٍ لَنَا، فَرَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى لَبِنَتَيْنِ مُسْتَقْبِلاً بَيْتَ الْمَقْدِسِ لِحَاجَتِهِ‏

লোকে বলে পেশাব পায়খানা করার সময় কিবলার দিকে এবং বাইতুল মাকদিসের দিকে মুখ করে বসবে না। আবদুল্লাহ ইবনু উমার বলেন, আমি একদা আমাদের ঘরের ছাদে উঠলাম। অতঃপর রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে দেখলাম বাইতুল মাকদিসের দিকে মুখ করে দু’টি ইটের উপর স্বীয় প্রয়োজনে বসেছেন। —সহিহুল বুখার, হাদিস নং ১৪৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৬

৩. জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রাদি. সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,

نَهَى نَبِيُّ اللهِ صلي الله عليه وسلم أَنْ نَسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةَ بِبَوْلٍ فَرَأَيْتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْبَضَ بِعَامٍ يَسْتَقْبِلُهَا

আল্লাহর নাবি ﷺ কিবলামুখী হয়ে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তার ইন্তিকালের এক বছর পূর্বে কিবলামুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করতে দেখেছি। —সুনানে আবু দাউদ, (অধ্যায়: পবিত্রতা অর্জন, অনু. এ বিষয়ে [কিবালামুখী হয়ে ইস্তিনজার] অনুমতি সম্পর্কে) হাদিস নং ১৩; সুনানে তিরমিযি, (অধ্যায়: পবিত্রতা, অনু. এ বিষয়ের [কিবালামুখী হয়ে ইস্তিনজার] অনুমতি সম্পর্কে) হাদিস নং ৯, ইমাম তিরমিযী বলেন, এ হাদিসটি হাসান গরিব। সুনানে ইবনু মাজাহ (অধ্যায়: পবিত্রতা, অনু. ঘরের মধ্যে কিবলামুখী হয়ে ইস্তিনজা করার অনুমতি) হাদিস নং ৩২৫

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহি. বলেন, ইমাম বুখারি রাহি. হাদিসটিকে হাসান সহিহ বলেছেন। —শারহুল উমদাহ ১/১৫০

ইমাম নাববি রাহি. হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। — আল-মাজমু ২/৮২

শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি রাহি. হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। —সহিহ সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং ৯

৪. মারওয়ান আল-আসফার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দেখলাম,

رأيتُ ابنَ عمرَ أناخ راحِلتَه مستقبِلَ القِبلة، ثمَّ جلسَ يبولُ إليها: فقلتُ: يا أبا عبدِ الرَّحمن، أليس قد نُهِيَ عن هذا؟ قال: بلى، إنَّما نُهِيَ عن ذلك في الفَضاءِ، فإذا كان بينَك وبين القِبلةِ شيءٌ يستُرُك فلا بأسَ

ইবনু উমার রাদি. তার উটকে কিবলার দিকে বসালেন। অতঃপর ঐ উটের দিকে মুখ করে বসে পেশাব করলেন। আমি বললাম, হে আবু আবদুর রহমান! এ থেকে (অর্থাৎ কিবলামুখী হয়ে পেশাব করতে) নিষেধ করা হয়নি কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তবে এ নিষেধ উন্মুক্ত ময়দানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তোমার এবং কিবলার মাঝে কোন কিছুর আড়াল থাকলে তা দোষনীয় নয়। —সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১; সহিহ ইবনু খুযায়মাহ, হাদিস নং ৬০; মুসতাদরাকে হাকিম ১/৫৪; বায়হাকি ১/৯২

ইমাম দারাকুতনি রাহি. বলেন, এটি সহিহ, এর প্রত্যেক বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। —সুনানে দারাকুতনি ১/৫৮

ইমাম হাকিম রাহি. বলেন, বুখারির শর্ত মোতাবেক সহিহ। এবং ইমাম যাহাবি রাহি. তার সাথে একমত পোষণ করেছেন।

ইমাম আল হাযিমি রাহি. বলেন, হাদিসটি হাসান। —আল ইতিবার ২৬

নাববি রাহি. এই হাদিসকে সহিহ বলেছেন। — আল-মিনহাজ, ৩/১৫৫

ইমাম শাওকানি রাহি. বলেন, হাদিসটি দলিলের উপযোগী। —নাইলুল আওতার ১/১০১

শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি রাহি. সহিহ সুনানে আবু দাউদ-এ হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। —হাদিস নং ১১

মাসয়ালার সমাধান :

উপর উল্লেখিত নুসুসকে সামনে রাখলে যে বিষয়টা স্পষ্টভাবে বুঝে আসে তা হলো— যখন কোন ব্যক্তি এমন স্থানে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করবে, যেখানে ব্যক্তির মাঝে এবং কিবলার মাঝে কোন অন্তরায় রয়েছে— এমতাবস্থায় কিবলার দিকে মুখ করে বা পিঠ দিয়ে বসে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করা জাইয রয়েছে। আর এমনটাই ইমাম শাফিয়ি, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রাহিমাহুমুল্লাহ বলেছেন। —শারহু মুখতাসারিল খলিল ১/১৪৩; আল মুদাউওয়ানাতুল কুবরা ১/১১৭; আয-যাখিরাহ ১/২০৪; মুগনিউল মহতাজ ১/৪০; আল-ইনসাফ ১/৮২

এছাড়াও উল্লেখিত আবু আইয়ুব আল আনসারি রাদি. হতে বর্ণিত হাদিসে الغائط (আল-গায়িত) শব্দের অর্থ হলো— المكانُ المُنخفِض তথা নিম্নাঞ্চল।

মজামুল ওয়াসিত-এ الغائط (আল-গায়িত) শব্দের অর্থ করা হয়েছে— المُنخَفِضُ الواسع من الأرض অর্থাৎ জমিনের বিস্তৃত নিম্নাঞ্চল।

মুজামুর রাইদ-এ الغائط (আল-গায়িত) শব্দের অর্থ করা হয়েছে—

غائط من الأرض السهل المنخفض الواسع

অর্থাৎ গায়িত হলো যমিনের সেই অংশ, যেটা সমতল-বিস্তৃত-নিম্নভূমি।

আর তা ছাড়া প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে বের হওয়াকে تغوط বলা হয়। তৎকালীন সময়ে আরবে এটা সর্বজনবিদিত বিষয় ছিল যে, লোকেরা তাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য ফাঁকা জায়গায় লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যেতেন। আল্লাহর রাসুল ﷺ ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

মুগিরাহ ইবনু শুবাহ রাদি. সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,

أَنَّ النَّبِيَّ صلي الله عليه وسلم كَانَ إِذَا ذَهَبَ الْمَذْهَبَ أَبْعَدَ

নাবি ﷺ যখন পায়খানার উদ্দেশ্যে যেতেন, তখন দূরে চলে যেতেন। —সুনানে আবু দাউদ (অধ্যায়: পবিত্রতা, অনু. পেশাব-পায়খানার জন্য নির্জন স্থানে যাওয়া প্রসঙ্গে), হাদিস নং ১; সুনানে তিরমিযি (অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পায়খানার বেগ হলে রাস্তা থেকে দূরে চলে যেতেন), হাদিস নং ২০; সুনানে ইবনু মাজাহ (অধ্যায়: পবিত্রতা ও তার সুন্নাত, অনু. পেশাব-পায়খানার জন্য দূরে জঙ্গলে যাওয়া) হাদিস নং ৩৩১; সুনানে নাসায়ি (অধ্যায়: পবিত্রতা, অনু. পেশাব-পায়খানার জন্য দূরে যাওয়া), হাদিস নং ১৭; সুনানে দারামি (অধ্যায়: পবিত্রতা, অনু. পেশাব-পায়খানার জন্য যাওয়া), হাদিস নং ৬৬০; সহিহ ইবনু খুযাইমাহ (অধ্যায়: উযু, অনু. মানুষের চোখের অন্তরাল হওয়ার উদ্দেশ্যে পেশাব-পায়খানার জন্য দূরে যাওয়া) হাদিস নং ৫০; সুনানুল কুবরা (অধ্যায়: পবিত্রতা, অনু. পেশাব পায়খানার জন্য নির্জনে যাওয়া)

ইমাম তিরমিযি বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ। ইমাম হাকিম বলেন, এটি ইমাম মুসলিম রাহি.-এর শর্তে সহিহ। ইমাম যাহাবি রাহি.ও তার সাথে একমত পোষণ করেছেন।

উপর উল্লেখিত কারণে ইমাম ইবনু দাকিক আল-ইদ রাহি. বলেন,

ففي الحديثِ إشارةٌ أنَّ المرادَ النَّهيُ عن استقبالِ القِبلةِ واستدبارِها في الفَضاءِ

(আবু আইয়ুব আল-আনসারি রাদি. হতে বর্ণিত) হাদিসে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, (প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের সময়) কিবলাকে সামনে বা পেছনে রাখার নিষেধাজ্ঞার দ্বারা— ফাঁকা জায়গা বা খোলা ময়দানে প্রাকৃতিক প্রয়োজন উদ্দেশ্য। —ইহকামুল আহকাম ৪৮-৪৯

আর যদি এটা মেনে নেওয়া হয় যে, আবু আইয়ুব আল-আনসারি রাদি. হতে বর্ণিত হাদিসটি সকল জায়গায় (ফাঁকা জায়গা বা বিল্ডিং বা ঘরের ভেতর) প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য, তাহলে সে কথাই বলা যথেষ্ট হবে, যে কথা হাফিয ইবনু হাজার আল-আসকলানি রাহি. বলেছেন। তিনি বলেন,

ولولا أنَّ حديثَ ابنِ عُمَرَ دلَّ على تخصيصِ ذلك بالأبنيةِ، لقُلنا بالتَّعميم، لكنَّ العمَلَ بالدَّليلينِ أَولى من إلغاءِ أحَدِهما

যদি ইবনু উমার রাদি.-এর হাদিসটি উল্লেখিত মাসয়ালাকে বিল্ডিং বা ঘরের সাথে নির্দিষ্ট না করত তবে অবশ্যই আমরা ব্যাপকতার কথা বলতাম। অর্থাৎ খোলা জায়গায় বা বিল্ডিং ও ঘরের ভিতর— সকল ক্ষেত্রেই একই হুকুম। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, (যখন কোন ক্ষেত্রে দুইটা হাদিস থাকবে এবং উভয়টাই গ্রহণযোগ্য হবে, তখন) তখন একটা হাদিসের ওপর আমল পরিত্যাগ করে অপরটার ওপর আমল করার থেকে উভয় হাদিসের উপর একই সঙ্গে আমল করা (সম্ভব হলে সেটা করাই) উত্তম। —ফতহুল বারি, ১/২৪৫-২৪৬

وإنما التقوى فوق الفتوى، هذا ما عندي والله اعلم

আবদুল্লাহ আল মামুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *