মৌমাছি : এক মধুময় জীবনালেখ্য

মৌমাছি : এক মধুময় জীবনালেখ্য

আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানবজাতির প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় ব্যবস্থাও করেছেন। মানুষ ছাড়াও পৃথিবীতে বহু সৃষ্ট জীব আছে। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে এগুলো মানবজাতির কল্যাণে নিয়োজিত। মানুষের মতো তাদেরও রয়েছে ভূপৃষ্ঠে অবাধ বিচরণ। তারাও আল্লাহ তাআলার বিশাল সৃষ্ট পরিবারের সদস্য।

আল্লাহ তাআলা প্রাণী সম্পর্কে বলেন,

আর যমিনে বিচরণশীল প্রতিটি জীব বা দুডানা দিয়ে উড়ে এমন প্রতিটি পাখি ,তোমাদের মতো এক একটি উম্মত। এ কিতাবে আমি কোন কিছুই বাদ দেইনি; তারপর তাদেরকে তাদের রবের দিকে একত্র করা হবে। —সুরাহ আল-আনআম, আয়াত ৩৮

অর্থাৎ, এদেরকেও আল্লাহ তাআলা ঐভাবেই সৃষ্টি করেছেন, যেভাবে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অনুরূপ তাদেরকেও তিনি রিযক দেন, যেরূপ আমাদেরকে রিযক দেন এবং আমাদের মত তারাও তার শক্তি ও জ্ঞানের আওতাভুক্ত।

এই প্রাণীদের মধ্যে কালো ও সোনালি দাগ কাটা ছোট্ট এক প্রাণী— মৌমাছি। এটি আল্লাহ তাআলার রহস্যময় সৃষ্টি। ফুলে ফুলে মৌমাছি উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে বাগানপ্রেমীরা আপ্লুত হন। আল্লাহ তাআলার এই ক্ষুদ্র কিট নিয়ে যে ভাববে তার ইমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা মৌমাছির নামে একটি সুরা নাযিল করেছেন। মৌমাছির আরবি নাম ‘নাহল’। কুরআনের ১৬তম সুরাহ হচ্ছে সুরাহ আন-নাহল।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

আর আপনার রব মৌমাছিকে তার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন, ঘর তৈরী কর পাহাড়ে, গাছে ও মানুষ যে মাচান তৈরী করে তাতে; এরপর প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু খাও, অতঃপর তোমার রবের সহজ পথ অনুসরণ কর। তার পেট থেকে নির্গত হয় বিভিন্ন রঙ এর পানীয়; যাতে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য। নিশ্চয় এতে রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন। —সুরাহ আন-নাহল, আয়াত ৬৮-৬৯

আয়াতে আল্লাহ তাআলা অহি শব্দ ব্যবহার করেছেন। অহির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এমন সূক্ষ্ম ও গোপন ইশারা, যা ইশারাকারী ও ইশারা গ্রহনকারী ছাড়া তৃতীয় কেউ টের পায় না। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে এ শব্দটি ইলকা বা মনের মধ্যে কোন কথা নিক্ষেপ করা ও ইলহাম বা গোপনে শিক্ষা ও উপদেশ দান করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে অহি করার অর্থ ইলহাম, হিদায়াত ও ইরশাদ।

“রবের সহজ পথ” এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে :

  • তুমি অনুগত হয়ে সে পথে চল যে পথ তোমার রব তোমাকে শিখিয়েছেন এবং বুঝিয়েছেন। রবের রাস্তা বলা হয়েছে এজন্যে যে, সে রবই তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ পথে চলা শিখিয়েছেন। সুতরাং তুমি তোমার রবের শিখিয়ে পথগুলোতে বিভিন্ন স্থানে রিযিকের খোঁজে বেরিয়ে পড়। পাহাড়ে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে।
  • ২. অথবা আয়াতের অর্থ, হে মৌমাছি! তুমি যা খেয়েছ তা তোমার রবের নির্দেশক্রমে ও তার শক্তিতে তোমার শরীরের মধ্য দিয়ে মধু তৈরীর প্রক্রিয়া পরিণত কর।
  • অথবা আয়াতের অর্থ, হে মৌমাছি! যখন তুমি দূরে কোন স্থানে মধু আহরণের জন্য যাবে, তখন সেটা সংগ্রহ করে আবার তোমার গৃহে ফিরে আস, তোমার প্রভুর শিখিয়ে দেয়া পথসমূহ অবলম্বন করে। পথ হারিয়ে ফেলো না।
    মূলত: তিনটি অর্থই উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব।

এখানে অহির মাধ্যমে প্রদত্ত এই নির্দেশের যথাযথ ফলশ্রুতি বর্ণনা করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে, তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় বের হয়। এতে মানুষের জন্য রোগের প্রতিষেধক রয়েছে। খাদ্য ও ঋতুর বিভিন্নতার কারণে মধুর রঙ বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণেই কোন বিশেষ অঞ্চলে কোন বিশেষ ফল-ফুলের প্রাচুর্য থাকলে সেই এলাকার মধুতে তার প্রভাবও স্বাদ অবশ্যই পরিলক্ষিত হয়। মধু সাধারণতঃ তরল আকারে থাকে, তাই একে পানীয় বলা হয়েছে। এ বাক্যেও আল্লাহর একত্ব ও অপার শক্তির অকাট্য প্রমাণ বিদ্যমান। একটি ছোট্ট প্রাণীর পেট থেকে কেমন উপাদেয় ও সুস্বাদু পানীয় বের হয়। এরপর সর্বশক্তিমানের আশ্চর্যজনক কারিগরি দেখুন, অন্যান্য দুধের জন্তুর দুধ ঋতু ও খাদ্যের পরিবর্তনে লাল ও হলদে হয় না, কিন্তু মৌমাছির মধু সাদা, হলুদ, লাল ইত্যাদি বহু রঙের হয়ে থাকে।

মধু যেমন বলকারক খাদ্য এবং রসনার জন্য আনন্দ এবং তৃপ্তিদায়ক, তেমনি রোগ-ব্যাধির জন্যও ফলদায়ক ব্যবস্থাপত্র। মধু বিরেচক এবং পেট থেকে দূষিত পদার্থ অপসারক। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে কোন এক সাহাবি তার ভাইয়ের অসুখের বিবরণ দিলে তিনি তাকে মধু পান করানোর পরামর্শ দেন। দ্বিতীয় দিনও এসে আবার সাহাবি বললেন, অসুখ পূর্বের ন্যায় বহাল রয়েছে। তিনি আবারো একই পরামর্শ দিলেন। তৃতীয় দিনও যখন সংবাদ এল যে, অসুখে কোন পার্থক্য হয়নি, তখন তিনি বললেন,

صَدَقَ اللّٰهُ وَكَذَبَ بَطْنُ اَخِيْكَ

অর্থাৎ আল্লাহর উক্তি নিঃসন্দেহে সত্য, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যাবাদী। যাও তাকে মধু খাইয়ে দাও, তারপর লোকটি গিয়ে মধু খাওয়ানোর পর সে আরোগ্য লাভ করল। —সহিহুল বুখারি, হাদিস নং ৫৭১৬, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২২১৭

এখানে আল্লাহ তাআলার উক্তি সত্য এবং পেট মিথ্যাবাদী হওয়ার উদ্দেশ্য এই যে, ঔষধের দোষ নাই। রুগীর বিশেষ মেজাযের কারণে ঔষধ দ্রুত কাজ করেনি। এরপর রুগীকে আবার মধু পান করানো হয় এবং সে সুস্থ হয়ে উঠে। তবে সমস্ত রোগের জন্য সরাসরি মধু ব্যবহার করতে হবে তা এ আয়াতে বলা হয়নি। আবার কখনো কখনো বিভিন্ন উপাদানের সাথে মিশে তা আরোগ্য দানকারী প্রতিষেধকে পরিণত হয়। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা দুটি আরোগ্যকে আঁকড়ে ধরবে, কুরআন এবং মধু। —সুনানে ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ৩৪৫২, মুস্তাদরাকে হাকিম ৪/২০০

রাসুলুল্লাহ ﷺ অপর হাদিসে বলেন,

তিনটি বস্তুতে আরোগ্য রয়েছে, শিঙ্গা, মধু এবং আগুনের ছেঁক। তবে আমি আমার উম্মাতকে ছেঁক দিতে নিষেধ করি। —সহিহুল বুখারি, হাদিস নং ৫৬৮০, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২২০৫

তবে আলোচ্য আয়াতে শিফা (شفاء) শব্দটি থেকে মধু যে প্রত্যেক রোগের ঔষধ, তা বোঝা যায় না। কিন্তু শিফা শব্দের তানউইন (تنوين) যা তাযিম (تعظيم) এর অর্থ দিচ্ছে, তা থেকে অবশ্যই বোঝা যায় যে, মধুর নিরাময় শক্তি বিরাট ও স্বতন্ত্র ধরণের। যদিও কোন কোন আলিম বলেন, মধু সর্বরোগের প্রতিষেধক। তারা আল্লাহ তাআলার উক্তির বাহ্যিক অর্থেই এমন প্রবল ও অটল বিশ্বাস রাখেন যে, তারা ফোঁড়া ও চোখের চিকিৎসাও মধুর মাধ্যমে করেন এবং দেহের অন্যান্য রোগেরও।

এ কারণেই হয়তঃ রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজেও মধু পছন্দ করতেন। —সহিহুল বুখারি, হাদিস নং ৫৪৩১, ৫৬১৪, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪৭৪, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৭৫১, সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং ১৮৩২, ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ৩৩২৩,

ইবনু উমার রাদি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার শরীরে ফোঁড়া বের হলেও তিনি তাতে মধুর প্রলেপ দিয়ে চিকিৎসা করতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলতেন, আল্লাহ তাআলা কুরআনে কি মধু সম্পর্কে

فِيْهِ شِفَاءٌ لِّلنَّاسِ

বলেননি? অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

এতে (অর্থাৎ মধুতে) মৃত্যু ছাড়া আর সব রকমের রোগের আরোগ্য রয়েছে। —সুনানে ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ৩৪৫৭

আয়াতের মর্ম অনুযায়ী আরো জানা গেল যে, ঔষধের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করা বৈধ।
কারণ, আল্লাহ তাআলা একে নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

হাদিসে ঔষধ ব্যবহার ও  চিকিৎসার প্রতি উৎসাহ দান করা হয়েছে। মোটকথা, চিকিৎসা করা ও ঔষধ ব্যবহার করা যে বৈধ, এ বিষয়ে সকল আলেমই একমত এবং এ সম্পর্কে বহু হাদিস ও রিওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে।

নিশ্চয় এ ছোট প্রাণীটিকে সঠিক পথে সহজভাবে চলার ইলহাম করা, বিভিন্ন গাছ থেকে মধু নেয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া, তারপর সেটাকে মোমের মধ্যে ও মধুর জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে রাখা যা অন্যতম উত্তম বস্তু হিসেবে বিবেচিত। অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে বড় নিদর্শন রয়েছে। যা তার সৃষ্টিকর্তার মহত্বতার উপর প্রমাণবহ। এর দ্বারা তারা এটার উপর প্রমাণ গ্রহণ করবেন যে, তিনি সব করতে সক্ষম, প্রাজ্ঞ, জ্ঞানী, দাতা, দয়ালু।

মৌমাছির পরিবার :

মানুষের মতো মৌমাছির রয়েছে পরিবারব্যবস্থা। একটি মৌচাকে বা পরিবারে তিন শ্রেণির মৌমাছি থাকে। যথা—রানি, পুরুষ ও  শ্রমিক মৌমাছি। রানি মৌমাছি সবচেয়ে বড় প্রকৃতির। একটি চাকে একটিমাত্র রানি মৌমাছি থাকে। এর একমাত্র কাজ ডিম পাড়া। রানি কোন ধরনের ডিম পাড়বে তা তার ইচ্ছাধীন। প্রতিদিন এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ ডিম পাড়ে। জীবনের শেষে তার পাড়া ডিমের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন-চার মিলিয়ন। একটি রানি মৌমাছির আয়ুষ্কাল প্রায় দুই থেকে তিন বছর।

রানির সঙ্গে শুধু একটি পুরুষ মৌমাছি মিলিত হতে সক্ষম। তবে মিলিত হওয়ার পর সেই পুরুষ মারা যায়। পুরুষ মৌমাছির আয়ুষ্কাল প্রায় দেড় মাস।

রানি ও পুরুষ বাদে অবশিষ্ট সব সদস্যই শ্রমিক মৌমাছি। এরা নানা দলে ভাগ হয়ে চাকের যাবতীয় কাজ, যেমন—চাক নির্মাণ, ফুলের রস ও পরাগরেণু সংগ্রহ, মধু তৈরি, চাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, চাকে বাতাস দেওয়া, চাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি সম্পন্ন করে। এদের আয়ুষ্কাল প্রায় এক মাস।

যেভাবে মধু আহরণ করে :

মহান আল্লাহ বলেন,

‘এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ করো এবং নিজ পালনকর্তার উন্মুক্ত পথে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।—সুরাহ আন-নাহল, আয়াত ৬৯

প্রথম ধাপে কর্মী মৌমাছি মাঠে গিয়ে ফুলের মধুগ্রন্থি থেকে মধু সংগ্রহ করে। এই সংগৃহীত মধু তারা তাদের দেহের বিশেষ এক থলিতে জমা রাখে। মধু সংগ্রহ শেষে তারা মৌচাকে ফিরে যায়। কর্মী মৌমাছি তাদের সংগৃহীত ফুলের মধু মৌচাকে থাকা মৌমাছির মুখে দিয়ে দেয়। এরপর মৌচাকের এই মৌমাছিগুলো ফুলের রসের সঙ্গে তাদের শরীর থেকে বেশ কয়েক ধরনের এনজাইম (এক ধরনের জৈব-রাসায়নিক অনুঘটক বা উৎসচক পদার্থ) যোগ করে এবং মৌচাকে এই রস জমা করে রাখে। এভাবে বেশ কিছুদিন পর জমা করা এই বিশেষ রস গাঢ় মধুতে রূপান্তরিত হয়।

প্রাণিবিদরা বলেন, এক কেজি মধু সংগ্রহ করতে মৌমাছির চার মিলিয়ন ফুল দরকার হয়। একই পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে মৌমাছির এক লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সাত থেকে আট মিনিট সময়ে এরা এক কিলোমিটার উড়তে সক্ষম। একটি মৌমাছি সারা জীবনে অর্ধেক চা চামচের সমপরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে পারে। একটি মৌচাকে গড়ে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মৌমাছি থাকে। মধু সংগ্রহের জন্য একটি মৌমাছি ৫০ থেকে ১০০টি ফুলে বসে। (কানাডিয়ান হানি কাউন্সিল অবলম্বনে)

আর হ্যাঁ, এই বিস্ময়কর পদ্ধতিতে মানুষের কাছে মধু পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন মহান আল্লাহ। হে আল্লাহ! আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা।

আবদুল্লাহ আল মামুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *