হাদিয়া চাওয়ার বিধান

হাদিয়া চাওয়ার বিধান:

আদর্শ সমাজের লেন–দেনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পারস্পরিক হাদিয়ার আদান-প্রদান। এর দ্বারা অন্তরে মহব্বত ভালোবাসা তৈরি হয়। সম্পর্ক দৃঢ় হয়। যেটি দুনিয়ার জীবনে অনেক বড় নিআমত।

হাদিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে কুরআন–হাদিসে ও ফিকহের কিতাবগুলিতে আলোচনা হয়েছে। তার ভেতর অন্যতম একটা বিষয়— হাদিয়া চাওয়ার বিধান।

হঠাৎ অনলাইনে হাদিয়াকে কেন্দ্র করে আমাদের মাঝে এক প্রান্তিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারো কারো আলোচনা থেকে মনে হচ্ছে যে, হাদিয়া চাওয়া মনে হয় শরিআতে বৈধ নয়; এটা শরিআত কর্তৃক নিষিদ্ধ একটা বিষয়। অথচ শরিআতে হাদিয়া চাওয়াকে নিষেধ করা হয়েছে–এমন কোনো বর্ণনা কি দেখানো যাবে?! বরং সাহাবিদের আমল থেকে তো দেখা যায় যে, তারা মাঝেমধ্যে হাদিয়া চেয়েছেন। শুধু তাই নয়; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে হাদিয়া চেয়েছেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সেই জিনিস দিয়েছেনও। তিনি তাকে হাদিয়া চাওয়া থেকে নিষেধও করেননি।

উতবাহ ইবনু আবদ আস-সুলামী রাদি. সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,

اسْتَكْسَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَكَسَانِي خَيْشَتَيْنِ فَلَقَدْ رَأَيْتُنِي وَأَنَا أَكْسَى أَصْحَابِي.

একদা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আমাকে চাদর পরিয়ে (হাদিয়া) দেয়ার আবেদন করলে তিনি আমাকে ‘কাতান’ জাতীয় দু’টি সূক্ষ্ম কাপড় পরিয়ে দিলেন। আমি আমার গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আমি সকল বন্ধুদের চেয়ে উত্তম পোশাক পরিধানকারী। – [১]

হাদিস থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে আল্লহর নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবিদের কাছে হাদিয়া চেয়েছেন।

সালামাহ রাদি. বলেন, আমরা ফাযারাহ গোত্রের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। আবু বাকর রাদি. ছিলেন আমাদের আমির। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আমাদের আমির নিযুক্ত করেছিলেন। যখন আমাদের এবং পানির স্থানের মাঝে একঘণ্টা সময়ের ব্যবধান ছিল, তখন আবু বাকর রাদি. আমাদেরকে (রাতের শেষের দিকে সেখানে অবতরণের) নির্দেশ দিলেন। সুতরাং আমরা রাতের শেষাংশেই সেখানে অবতরণ করলাম। এরপর বিভিন্ন দিক দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পানির নিকট পৌছলেন। আর যাদেরকে তার বিরুদ্ধে পেলেন হত্যা এবং বন্দী করলেন। আমি লোকদের একটি দলকে দেখতে পাচ্ছি যাদের মধ্যে শিশু ও নারী রয়েছে। আমি আশংকা করছিলাম যে, তারা হয়তোবা আমার আগেই পাহাড়ে পৌছে যাবে। অতএব আমি তাদের ও পাহাড়ের মাঝে তীর নিক্ষেপ করলাম। তারা তখন তীর দেখতে পেয়ে থেমে গেল। তখন আমি তাদের হাঁকিয়ে নিয়ে এলাম। তাদের মাঝে চামড়ার পোশাক পরিহিত ফাযারা গোত্রের একজন মহিলাও ছিল এবং (রাবী বলেন) তার সঙ্গে তার এক কন্যা ছিল। সে ছিল আরবের সবচেয়ে সুন্দরী। আমি সকলকেই হাকিয়ে আবু বাকর রাদি. এর কাছে নিয়ে এলাম।

আবি বকর রাদি. মহিলার কন্যাটি আমাকে নফল হিসেবে প্রদান করলেন। এরপর আমি মাদিনায় ফিরে এলাম। আমি তখনও তার বস্তু উঠাইনি। পরে বাজারে আমার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন,

يَا سَلَمَةُ هَبْ لِي الْمَرْأَةَ

হে সালামাহ তুমি মহিলাটি আমাকে দিয়ে দাও। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তাআলার কসম, তাকে আমার অত্যধিক পছন্দ হয়েছে এবং এখনও আমি তার বস্ত্র উঠাইনি। পরের দিন আবারও বাজারে আমার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাৎ হলো। তখন তিনি বললেন,

يَا سَلَمَةُ هَبْ لِي الْمَرْأَةَ لِلَّهِ أَبُوكَ

হে সালামাহ! তুমি মহিলাটি আমাকে দিয়ে দাও। আল্লাহ তোমার পিতার কল্যাণ করুন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কসম। সে আপনার জন্যই (আমি এটা আপনাকে দিয়ে দিলাম)। আমি তার বস্ত্র উন্মোচন করিনি। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ কন্যাটিকে মাক্কায় পাঠিয়ে দিয়ে তার বিনিময়ে কয়েকজন মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করে আনলেন, যারা মাক্কায় ইতোপূর্বে বন্দী ছিল। – [২]

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, সালামাহ রাদি. বলেন,

خَرَجْتُ مَعَ أَبِي بَكْرٍ فِي غَزَاةِ هَوَازِنَ، فَنَفَّلَنِي جَارِيَةً، فَاسْتَوْهَبَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَبَعَثَ بِهَا إِلَى مَكَّةَ، فَفَدَى بِهَا أُنَاسًا مِنَ الْمُسْلِمِينَ.

আমরা আবু বাকর রাদি. সাথে হাওয়াযিন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেরিয়েছিলাম। তিনি (এ যুদ্ধে) আমাকে গনিমতের মালের নির্দিষ্ট অংশের অতিরিক্ত হিসেবে একটা দাসি দিয়েছিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা আমার কাছে হাদিয়া চান। (আমি হাদিয়া হিসেবে দিলে) তিনি দাসীটি দ্বারা (তাকে মাক্কায় পাঠিয়ে দিয়ে তার বিনিময়ে) কয়েকজন মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করে আনলেন। — [৩]

উল্লেখিত হাদিস দুটি যদিও একই প্রেক্ষাপটে, তারপর শব্দের ভিন্নতার জন্য দ্বিরুক্তি করলাম। সালামাহ রাদি.—এর দ্বিতীয় বর্ণ নয় আমরা দেখতে পেলাম তিনি শব্দ ব্যবহার করেছেন اسْتَوْهَبَ যার আক্ষরিক অর্থ হলো— দান চাওয়া, উপহার চাওয়া, হেবা চাওয়া, হাদিয়া চাওয়া ইত্যাদি। হয়তো কেউ এখানে বলবেন যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের জন্য হাদিয়া চেয়েছিলেন। কিন্তু এবিষয়টা হাদিয়া চাওয়ার বিধানের ক্ষেত্রে কোনরূপ প্রভাব ফেলবে না। কারণ রাসুল সালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিকে হাদিয়া চাওয়ার কারণ খুলে বলেননি। অথচ কারণ খুলে বললে সাহাবি প্রথম দিনেই ওটা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–কে দিয়ে দিতেন।

আর তাছাড়া উপরোল্লিখিত উতবাহ ইবনু আবদ আস-সুলামী রাদি.—এর হাদিসে দেখেছি তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে হাদিয়া চেয়ে ছিলেন, আর তিনি সাহাবির এই কর্মের প্রতি কোনরূপ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ছাড়াই তাকে সেই জিনিস দিয়েছিলেন। যেটাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর মৌন সমর্থন হিসেবে ধরা যেতেই পারে।

অতএব, এটা বলা যায় যে, হাদিয়া চাওয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণই ব্যক্তির উপর নির্ভর করছে। সে কার কাছে হাদিয়া চায়বে–এটা তার বিবেচনার ব্যাপার। কোন বিবেকবান মানুষ স্বাভাবিকভাবে এমন কারোর কাছে হাদিয়া চায় না, যাকে সে চেনে না, জানে না। আবার এদিকে নিকট আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের কাছে মানুষ হাদিয়া চায়তে লজ্জাও করে না। সুতরাং হাদিয়া চাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণই ব্যক্তির উপর নির্ভর করছে। হাদিয়া চাওয়ার কারণে কাউকে গালমন্দ করা বা লজ্জা দেওয়া এটা আদৌ উচিত হবে না আমাদের।

আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করেন। আমিন।

.

পাদটীকা


[১] – সুনানে আবু দাউদ, ৪০৩২; মুসনাদে আহমাদ, ১৭৬৫৬
[২] – সহিহ মুসলিম, ১৭৫৫; সুনানে আবু দাউদ, ২৬৯৭; মুসনাদে আহমদ, ১৬৫০২, ১৬৫৩৭
[৩] – মুসনাদে আহমদ, ১৬৫০৫

আবদুল্লাহ আল মামুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *