❝দায়ি ইলান নার❞ থেকে সাবধান!:
দায়ি (داعي) আরবি শব্দ। যার বাংলা অর্থ হলো আহ্বানকারী। এই আহ্বানকারী আবার দুইধরণের :
- ১. জান্নাতের দিকে আহ্বানকারী।
- ২. জাহান্নামের দিকে আহ্বানকরী।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে উভয় শ্রেণীর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ لَا تَنۡکِحُوا الۡمُشۡرِکٰتِ حَتّٰی یُؤۡمِنَّ ؕ وَ لَاَمَۃٌ مُّؤۡمِنَۃٌ خَیۡرٌ مِّنۡ مُّشۡرِکَۃٍ وَّ لَوۡ اَعۡجَبَتۡکُمۡ ۚ وَ لَا تُنۡکِحُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ حَتّٰی یُؤۡمِنُوۡا ؕ وَ لَعَبۡدٌ مُّؤۡمِنٌ خَیۡرٌ مِّنۡ مُّشۡرِکٍ وَّ لَوۡ اَعۡجَبَکُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ یَدۡعُوۡنَ اِلَی النَّارِ ۚۖ وَ اللّٰہُ یَدۡعُوۡۤا اِلَی الۡجَنَّۃِ وَ الۡمَغۡفِرَۃِ بِاِذۡنِہٖ ۚ وَ یُبَیِّنُ اٰیٰتِہٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّہُمۡ یَتَذَکَّرُوۡنَ
আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ইমান আনে এবং মুমিন দাসী মুশরিক নারীর চেয়ে নিশ্চয় উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। আর মুশরিক পুরুষদের সাথে বিয়ে দিয়ো না, যতক্ষণ না তারা ইমান আনে। আর একজন মুমিন দাস একজন মুশরিক পুরুষের চেয়ে উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। তারা তোমাদেরকে আগুনের দিকে আহবান করে, আর আল্লাহ তার অনুমতিতে তোমাদেরকে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন এবং মানুষের জন্য তার আয়াতসমূহ স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। — (সুরাহ আল-বাকারাহ, আয়াত ২২১)
আসলে যারা ইসলামি আদর্শবহির্ভূত ভিন্ন কোনো আদর্শের দিকে আহ্বান করে তাদের আহ্বানটাই প্রকৃতপক্ষে জাহান্নামের প্রতি আহ্বান হয়।
আলোচ্য আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে। মাসয়ালাটি হলো, মুসলিম পুরুষের বিয়ে কাফির নারীর সাথে এবং কাফির পুরুষের বিয়ে মুসলিম নারীর সাথে হতে পারে না। কারণ, কাফির স্ত্রী-পুরুষ মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্ক পরস্পরের ভালবাসা, নির্ভরশীলতা এবং একাত্মতায় পরস্পরকে আকর্ষণ করে। তা ব্যতীত এ সম্পর্কে প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। আর মুশরিকদের সাথে এ জাতীয় সম্পর্কের ফলে ভালবাসা ও নির্ভরশীলতার অপরিহার্য পরিণাম দাঁড়ায় এই যে, তাদের অন্তরে কুফর ও শিরকের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় অথবা কুফর ও শির্কের প্রতি ঘৃণা তাদের অন্তর থেকে উঠে যায়। এর পরিণামে শেষ পর্যন্ত সেও কুফর ও শিরকে জড়িয়ে পড়ে; যার পরিণতি জাহান্নাম। এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক জাহান্নামের দিকে আহবান করে। আল্লাহ তাআলা জান্নাত ও মাগফিরাতের দিকে আহবান করেন।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ جَعَلۡنٰہُمۡ اَئِمَّۃً یَّدۡعُوۡنَ اِلَی النَّارِ ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ لَا یُنۡصَرُوۡنَ
আর আমি তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম, তারা জাহান্নামের দিকে আহবান করত এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। —(সুরা আল-কাসাস, আয়াত ৪১)
আল্লাহ তাআলা ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গকে খারাপ ও নিন্দনীয় ব্যাপারে নেতা করে দিয়েছিলেন। সুতরাং দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে যারাই খারাপ কাজ করবে, যারাই কোন খারাপ কাজের প্রচার ও প্রসার ঘটাবে ও তার নেতৃত্ব দিবে, ফিরআউন ও তার পরিষদবৰ্গকে তারাই পূর্বসূরি হিসেবে পাবে। এরা হলো সমস্ত ভ্রান্ত মতবাদের নেতাগণ। এসকল ভ্রান্ত নেতারা জাতিকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করতে থাকে। কিয়ামত পর্যন্ত যারাই পথভ্রষ্ট কোন মত ও পথের দিকে মানুষকে আহ্বান করবে তারাই ফিরআউন ও তার সভাসদদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে থাকবে। দুনিয়াতে যে ব্যাক্তি মানুষকে কুফরি ও যুলুমের দিকে আহ্বান করে, সে প্রকৃতপক্ষে জাহান্নামের দিকেই আহ্বান করে।
আমরা যদি জাতিসমূহের পথভ্রষ্টতার উৎসের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তবে দেখতে পাব যে, সবচেয়ে প্রাচীন ভ্ৰষ্টতার উৎপত্তি ঘটেছে মিসর থেকে। ফিরআউন সর্বপ্রথম ❝ওয়াহদাতুল ওজুদ❞ তথা সৰ্বেশ্বরবাদের দাবি তুলেছিল। আর সে দাবি এখনো পর্যন্ত ভারত তথা হিন্দুস্থানের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও সুফিবাদের অনেকের মধ্যেই পাওয়া যায়। আর এ জন্যেই ফিরআউনকে অনেক সুফিরা ইমানদার বলার মত ধৃষ্টতা দেখায়।
এসকল দায়িরা সরাসরি কাউকে জাহান্নামের প্রতি আহ্বান করেনা; বরং তারা এমন কিছু মতাদর্শের দিকে বা মতাদর্শধারী ব্যক্তির আনুগত্যের দিকে আহ্বান করে, যা শারিআতে ইসলামিয়া-এর সাথে সাংঘর্ষিক। আর সেদিকে আহ্বান করা মানেই জাহান্নামের প্রতি আহ্বান করা।
এককথায় ফিরআউন ও তার সভাসদদের পরবর্তীতে যে কোন ব্যক্তি আল্লাহর একত্ববাদ বা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে, ফিরআউনিরা তার পথিকৃৎ নেতা ও অগ্রগামী গণ্য হবে, যারা ছিল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সাল্লাম ও ফিরআউনের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন,
وَ یٰقَوۡمِ مَا لِیۡۤ اَدۡعُوۡکُمۡ اِلَی النَّجٰوۃِ وَ تَدۡعُوۡنَنِیۡۤ اِلَی النَّارِ
আর হে আমার কওম, আমার কী হল যে, আমি তোমাদেরকে মুক্তির দিকে ডাকছি আর তোমরা আমাকে ডাকছ আগুনের দিকে! —(সুরাহ আল-গাফির, আয়াত ৪১)
জান্নাতের প্রতি আহবান হলো, কেবল এক আল্লাহরই ইবাদতের প্রতি আহবান করা, যার কোন শরিক নেই এবং তার সেই রাসুলকে সত্যজ্ঞানের প্রতি আহবান করা, যাকে তিনি আমাদের হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। আর জাহান্নামের প্রতি আহবান হলো, তাওহিদের পরিবর্তে শিরকের প্রতি দাওয়াত দেওয়া, যা মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। যেমনটা পরের আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
تَدۡعُوۡنَنِیۡ لِاَکۡفُرَ بِاللّٰہِ وَ اُشۡرِکَ بِہٖ مَا لَیۡسَ لِیۡ بِہٖ عِلۡمٌ ۫ وَّ اَنَا اَدۡعُوۡکُمۡ اِلَی الۡعَزِیۡزِ الۡغَفَّارِ
তোমরা আমাকে ডাকছ আমি যেন আল্লাহর সাথে কুফরি করি, তার সাথে শিরক করি যে ব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান নেই; আর আমি তোমাদেরকে ডাকছি মহাপরাক্রমশালী ও পরম ক্ষমাশীলের দিকে। —(সুরাহ আল-গাফির, আয়াত ৪২)
পূর্বের কথাগুলো ফিরআউনসম্প্রদায়ের একজন ইমানদার ব্যক্তির কথা, যা সে তার সম্প্রদায়কে লক্ষ করে বলেছিল। আর সে ছিলো প্রকৃতপক্ষে মুসা আলাইহিস সালাম-এর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী। তার সেই কথাগুলো আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জানিয়েছেন। সে তার সম্প্রদায়কে বলছিল, এটা কতই না আশ্চার্যজনক যে, আমি তোমাদেরকে আহ্বান করছি মুক্তির পথে, যে পথে চললে তোমরা নাজাত পাবে। আর তোমরা কিনা তার বদৌলতে আমাকে আহ্বান করছ জাহান্নামের দিকে। তোমরা আমাকে নির্দেশ দিচ্ছ যেন আমি এক আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করি, আর তার সাথে অংশীদার স্থাপন করি। আমি তোমাদেরকে আহ্বান করছি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল এক আল্লাহর দিকে, আর তোমরা আমাকে আহ্বান করছ এমন এক ব্যক্তির অনুসরণ করার যে কিনা দুনিয়া ও পরকাল কোথাও অনুসরণের যোগ্য নয়। বস্তুত আমাদেরকে এক আল্লাহরই অনুসরণ করতে হবে যার দিকে আমরা সকলেই প্রত্যাবর্তিত হব।
আর এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, মুসা আলাইহিস সালাম-এর অনুসারী সেই ব্যক্তিকে কেউ সরাসরি জাহান্নামের প্রতি আহবান করেনি। বরং তাকে ডাকা হয়েছিল মুসা আলাইহিস সালাম-এর আনুগত্য ত্যাগ করে ফিরআউনের আনুগত্যের দিকে; যে ফিরআউন ছিল আল্লাহদ্রোহী, তাগুত (সীমালংঘনকারী)। তার দিকে আহ্বান করাকে আল্লাহ তাআলা কুরআনে জাহান্নামের প্রতি আহ্বান করা সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং আজও যারা ফিরআউনের আদর্শ ও তার চিন্তা-চেতনাধারী ব্যক্তিদের দিকে বা এমন মতাদর্শের দিকে আহবান করে যা ইসলামি আদর্শবহির্ভূত, তারাও জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী বলেই বিবেচিত হবে।
আর এসকল দায়িগন জাহান্নামের পথের সর্দার ও অগ্রগামী হিসেবে গণ্য হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا مُوۡسٰی بِاٰیٰتِنَا وَ سُلۡطٰنٍ مُّبِیۡنٍ – اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِہٖ فَاتَّبَعُوۡۤا اَمۡرَ فِرۡعَوۡنَ ۚ وَمَاۤ اَمۡرُ فِرۡعَوۡنَ بِرَشِیۡدٍ – یَقۡدُمُ قَوۡمَہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ فَاَوۡرَدَہُمُ النَّارَ ؕ وَبِئۡسَ الۡوِرۡدُ الۡمَوۡرُوۡدُ – وَاُتۡبِعُوۡا فِیۡ ہٰذِہٖ لَعۡنَۃً وَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ بِئۡسَ الرِّفۡدُ الۡمَرۡفُوۡدُ
আর আমি মুসাকে আমার আয়াতসমূহ ও স্পষ্ট প্রমাণ দিয়ে পাঠিয়েছি, ফিরআউন ও তার নেতৃবৃন্দের কাছে। অতঃপর তারা ফিরআউনের নির্দেশের অনুসরণ করল। আর ফিরআউনের নির্দেশ সঠিক ছিল না। কিয়ামত দিবসে সে তার কওমের অগ্রভাগে থাকবে এবং তাদেরকে আগুনে উপনীত করে দেবে। যেখানে তারা উপনীত হবে সেটা উপনীত হওয়ার কতইনা নিকৃষ্ট স্থান! আর এখানে (দুনিয়ায়) লানত তাদের পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং কিয়ামত দিবসেও। কি নিকৃষ্ট প্রতিদান, যা তাদের দেয়া হবে। —(সুরাহ হুদ, আয়াত ৯৬-৯৯)
আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন নিদর্শন ও প্রমাণ দিয়ে মুসা আলাইহিস সালাম-কে ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গের কাছে প্রেরণ করেন।
আসলে পরিষদবর্গ জাতির সম্মানিত ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকদেরকে বলা হয়। ফিরআউনের সাথে তার দরবারের সম্মানিত লোকদের নাম এজন্য নেয়া হয়েছে যে, জাতির উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাই সর্ববিষয়ে দায়িত্বশীল হয়ে থাকে এবং জাতির মানুষ তাদের অনুসরণ করে থাকে। যদি তারা ইমান আনত তাহলে জাতির সবাই মুসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি ইমান আনত। ফিরআউনের সম্প্রদায় যেহেতু দুনিয়াতে তার অনুসরণ করেছে আখিরাতেও তারা ফিরআউনের অনুসারী হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاَتْبَعْنٰھُمْ فِیْ ھٰذِه الدُّنْیَا لَعْنَةً وَیَوْمَ الْقِیٰمَةِ ھُمْ مِّنَ الْمَقْبُوْحِیْنَ
তাদেরকে আমি নেতা করেছিলাম; তারা লোকদেরকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত; কিয়ামতের দিন তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এ পৃথিবীতে আমি তাদের ওপর লাগিয়ে দিয়েছি অভিসম্পাত এবং কিয়ামতের দিন তারা হবে ঘৃণিত। —(সুরাহ আল-কাসাস, আয়াত ৪২)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
وَقَالُوْا رَبَّنَآ إِنَّآ أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَا۬ءَنَا فَأَضَلُّوْنَا السَّبِيْلَا رَبَّنَآ اٰتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا
তারা আরো বলবে- হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তো অনুসরণ করেছিলাম আমাদের নেতাদের এবং আমাদের প্রধানদের। অতএব তারাই আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা অভিশাপ দিন। — (সুরাহ আল-আহযাব, আয়াত ৬৭-৬৮)
আর এ থেকে এটাও বুঝে আসে যে, দুনিয়াতে যে ভাল মানুষের অনুসারী হবে আখিরাতেও সে তারই অনুসারী হবে, আর যে খারাপ লোকের অনুসরণ করবে আখিরাতেও সে খারাপ লোকেরই অনুসরণ করবে।
আল্লাহতালা আমাদেরকে ❝দায়ি ইলান নার❞ থেকে ও তাদের অনুসারী হওয়া থেকে হিফাযত করেন। আমিন।