ইসলামের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডার

ইসলামের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডার

বাংলাদেশে নতুনপ্রবর্তিত শিক্ষা-কারিকুলামে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ ইস্যু আনা হয়েছে— (পড়ুন— প্রমোট করা হয়েছে)। এক্ষেত্রে তাদেরকে হিজড়া হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আর আমাদের সাধারণের মাঝেও অনেকেই তাদের হিজড়া মনে করে থাকেন; কিন্তু আসলে তারা হিজড়া নয়। বরং তারা বিশেষ অস্ত্রোপচার ও হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তি, যারা মানসিক দিক থেকে তাদের সৃষ্টিগত লিঙ্গের চেয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বেশি আসক্ত ছিলো। ফলে একসময় তারা অস্ত্রোপচার ও হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের দেহাবয়ব পরিবর্তন করে বিপরীত লিঙ্গের বেশ ধারণ করেছে।

তবে বিস্তৃত পরিভাষায় রূপান্তরিত লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার বলতে ‘ক্রস-ড্রেসার’ বা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধানকারীদেরও বোঝানো হয়, বাস্তবে তাদের লিঙ্গবোধ যাই হোক না কেন।

প্রশ্ন হলো, একজন মুসলিম কি চাইলেই তার লিঙ্গ রূপান্তর করতে পারেন? ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধানই বা কী?

এর জন্য আমাদের অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হতে হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, (অনুবাদ)

আমি (আল্লাহ) মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে।—সুরাহ আত-তিন, আয়াত, ৪

মানুষকে সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করা হয়েছে। একথার মানে এই যে, তাকে এমন উন্নত পৰ্যায়ের দৈহিক সৌষ্ঠব দান করা হয়েছে যা অন্য কোন প্ৰাণীকে দেয়া হয়নি। আয়াতে বর্ণিত تَقْوِيْم এর অর্থ কোন কিছুর অবয়ব ও ভিত্তিকে যেরূপ করা উচিৎ, সে-রকমভাবে পরিপূর্ণ আকারে গঠন করা। তা দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে দৈহিক অবয়ব এবং আকার-আকৃতি ও আচার-ব্যবহার ও মানুষ্যত্বের মাধ্যমে অন্যান্য সব প্রাণী অপেক্ষা সুন্দরতম করেছেন। আকার আকৃতির বাইরেও আল্লাহ তাআলা তাকে জ্ঞানী, শক্তিবান, বক্তা, শ্রোতা, স্রষ্টা, কুশলী এবং প্রজ্ঞাবান করেছেন। আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে স্বাভাবিক দেহাবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, সেটা তার জন্য উতকৃষ্ট নিআমত।

ইসলামি বিধি-বিধানের বাইরে গিয়ে আল্লাহ তাআলার দেওয়া স্বাভাবিক দেহাবয়ব, আকার আকৃতির পরিবর্তন-পরিবর্ধনের অধিকার কারো নেই এবং দেওয়া হয়নি। কুরআনের অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলার তার সৃষ্টির পরিবর্তন-পরিবর্ধনকে শয়তানের কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, (অনুবাদ)

সে (শয়তান) বললো, আমি অবশ্যই আপনার (আল্লাহর) বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করে নেবো। আমি অবশ্যই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবো; অবশ্যই তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করবো, আর অবশ্যই আমি তাদেরকে নির্দেশ দেবো, ফলে তারা পশুর কান ছিদ্র করবে। আর অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দেবো, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে। আর আল্লাহর পরিবর্তে কেউ শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। —সুরাহ আন-নিসা, আয়াত ১১৬-১১৯

উপরোক্ত আয়াতে অভিশপ্ত শয়তান আল্লাহ তাআলাকে বলেছিল যে, নিশ্চয়ই নির্দেশ দেব আর তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবেই। বোঝা গেল অহেতুক ট্রান্সজেন্ডার তথা বিশেষ অস্ত্রোপচার ও হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রূপান্তরিত লিঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে নিজের শরীরে স্বাভাবিক অবয়বের মাঝে বিকৃত করা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করার অন্তর্ভুক্ত।

আবদুল্লাহ রাদি. বলেন, আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন ওই সমস্ত নারীর প্রতি, যারা অন্যের শরীরে উল্কি অঙ্কন করে, নিজ শরীরে উল্কি অঙ্কন করায়, যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রু-চুল উপড়িয়ে ফেলে এবং দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। সেসব নারী আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি আনয়ন করে। —সাহিহুল বুখারি, হাদিস ৪৮৮৬

আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন করা বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। প্রথমত সেটা, যেটা এখন আলোচিত হলো। যেমন, কান কাটা, চিড়া এবং ছিদ্র করা, শরীরে উলকি অঙ্কন করা ইত্যাদি। এ ছাড়াও আরো কয়েকভাবে তা করা হয়। যেমন, আল্লাহ চাঁদ, সূর্য, পাথর এবং আগুন ইত্যাদি অনেক জিনিস বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে সেগুলোকে উপাস্যে পরিণত করা। আবার পরিবর্তনের অর্থ প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তন এবং হালাল ও হারামের মধ্যে পরিবর্তনও হয়। পুরুষের শারীরিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা, অনুরূপ মহিলাদের গর্ভাশয় তুলে ফেলে তাদের সন্তান জন্মানোর যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করাও এই পরিবর্তনের আওতায় পড়ে। মেকআপের নামে ভ্রূর চুল চেঁছে নিজের আকৃতির পরিবর্তন করা এবং চেহারা ও হাতে দেগে নকসা করা ইত্যাদিও এরই মধ্যে শামিল। আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তনে জঘন্য যে নতুন মাত্রা চালু হয়েছে এটা হলো ট্রান্সজেন্ডার। এ সবই হলো শয়তানি কার্যকলাপ, তা থেকে বিরত থাকা জরুরী। তবে পশু দ্বারা অধিক উপকৃত হওয়ার জন্য, তার ভালো গোশত লাভের জন্য অথবা এই ধরনের আরো কোন বৈধ উদ্দেশ্যে যদি তার খাসি করানো হয়, তবে তা বৈধ হবে। এর সমর্থন এ থেকেও হয় যে, রাসুল ﷺ খাসি ছাগল কুরবানিতে জবাই করেছেন। যদি পশুর খাসি করানো বৈধ না হত, তাহলে তিনি তার কুরবানি করতেন না।

বিশেষজ্ঞ আলিমদের মতে, কেউ যদি সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নিজের দেহাবয়বে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনে, তবে তা আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতির শামিল হবে; তবে কেউ যদি রোগমুক্তির আশায় বাধ্য হয়ে চিকিৎসা হিসেবে এমনটি করে বা কোনো শারীরিক ত্রুটি দূর করার জন্য বাধ্য হয়ে করে, তবে তা আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতির অন্তর্ভুক্ত হবে না। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হারিস রাদি. বলেন, রাসুল ﷺ অভিসম্পাত করেছেন সুদখোর, সুদদাতা, সুদের সাক্ষী, সুদের লেখক এবং যে শরীরে দাগ দেয়, যাকে দাগ দেওয়া হয়। এক ব্যক্তি বলল, রোগের জন্য ছাড়া? তিনি বলেন, হ্যাঁ। —সুনানে নাসায়ি, হাদিস ৫১০৪

কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। উল্লেখিত মাসয়ালার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ ট্রান্সজেন্ডারের চিন্তা বিকৃত মানসিকতা বা মানসিক রোগ থেকে সৃষ্ট, তাই তাদের লিঙ্গে অস্ত্রোপচার না করে তাদের মানসিক চিকিৎসায় জোর দেওয়া উচিত। তাদের সমস্যাগুলো যদি হরমোনগত সমস্যা থেকে হয়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি বিকৃতির অধিকার কারো নেই। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক কন্যাশিশুর জন্মের সময় যোনিপথ বন্ধ থাকে, যা অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব, সেক্ষেত্রে চিকিৎসা গ্রহণকে ইসলাম নিষিদ্ধ বলে না। এবং পরিভাষায় সেই অস্ত্রোপচারকে ট্রান্সজেন্ডারও বলে না। উপরন্তু যেসব নারী- পুরুষের বেশভূষা নিতে চায় এবং যেসব পুরুষ নারীর বেশভূষা নিতে চায়, রাসুল ﷺ তাদের উভয়কেই অভিসম্পাত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল ﷺ নারীর বেশধারী পুরুষদের এবং পুরুষের বেশধারী নারীদের অভিসম্পত করেছেন। —সুনানে তিরমিযি, হাদিস ২৭৮৫

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে— বিকৃত-মস্তিস্কের থেকে তৈরি হওয়া ট্রান্সজেন্ডারের মতো অতি-জঘন্য ঘৃণিত কাজ থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন।

আবদুল্লাহ আল মামুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *