চার প্রশ্নের একই উত্তর – আমি

চার প্রশ্নের একই উত্তর – আমি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

! حامداً ومصلياً ومسلماً، أما بعد

ফজরের আজান হচ্ছে। মুয়াজ্জিন মহান রবের দিকে ডাকছে। ঘুম অপেক্ষা সালাত উত্তম। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু বকর সিদ্দিক রাদি. তার বিছানা ত্যাগ করে বের হলেন। অযু করলেন এবং ভালভাবে অযু করলেন। ধীর-স্থিরভাবে পূর্ণ বিনয়ের সাথে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন মহাপরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল রবের আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দেওয়ার জন্যে। যথাযথভাবে জামাআতের সাথে সালাত আদায় করলেন।

অতঃপর দিনের কোন এক সালাত শেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্ঠ শুনতে পেলেন। তিনি তার প্রিয় সাহাবিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,

من أصبح منكم اليوم صائمًا؟

আজ তোমাদের মাঝে কে সাওম পালনকারী?
আবু বকর রাদি. উত্তর দিলেন- আমি।
আবারো তিনি প্রশ্ন করলেন,

فمن تبع منكم اليوم جنازة؟

আজ তোমাদের মাঝে কে একটা জানাযায় শরিক হয়েছ?
আবু বকর রাদি. উত্তর দিলেন- আমি।
আবারো তিনি প্রশ্ন করলেন,

فمن أطعم منكم اليوم مسكينًا؟

তোমাদের মাঝে কে একজন মিসকীনকে আজ খাবার দিয়েছো?
আবু বকর রাদি. উত্তর দিলেন- আমি।
আবারো তিনি প্রশ্ন করলেন,

فمن عاد منكم اليوم مريضًا؟

তোমাদের মাঝে কে আজ একজন অসুস্থকে দেখতে গিয়েছো?
আবু বকর রাদি. উত্তর দিলেন- আমি।
তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

ما اجتمعن في امرئ إلا دخل الجنة

যার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো একত্রিত হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[১]

আল্লাহু আকবার! কত বড় কথা!! যার মধ্যে এ চারটি বৈশিষ্ট্য একত্রিত হবে, সে জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এখন আমরা এই চারটা বৈশিষ্ট্যের একটু গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করব। দুআ করি, আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের মাঝে এই চারটা বৈশিষ্ট্যকে একত্রিত করে দেন এবং জান্নাতিদের অন্তর্ভুক্ত করেন। আমিন।

১ম বৈশিষ্ট্য : সাওম (রোযা)

হে আল্লাহর বান্দা! সাওমের ফযিলত আপনার অজানা নয়। ইসলামের পঞ্চভিত্তির একটি হলো সাওম। এটি গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

فِتْنَةُ الرَّجُلِ فِي أَهْلِهِ وَمَالِهِ وَوَلَدِهِ وَجَارِهِ تُكَفِّرُهَا الصَّلاَةُ وَالصَّوْمُ وَالصَّدَقَةُ وَالْأَمْرُ وَالنَّهْيُ

মানুষ নিজের পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পাড়া-প্রতিবেশীদের ব্যাপারে যে ফিতনায় পতিত হয়; সালাত, সাওম, সাদাকাহ, (ন্যায়ের) আদেশ ও (অন্যায়ের) নিষেধ তা দূরীভূত করে দেয়।[২]
সাওম (কুপ্রবৃত্তির মুকাবিলায়) ঢালস্বরূপ। এটা বান্দাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে।[৩]

সাওম এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যাকে আল্লাহ নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

قَالَ اللهُ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সাওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সাওম আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব। সাওম ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সায়িম। যার কবজায় মুহাম্মাদের প্রাণ, তার শপথ! অবশ্যই সাওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের চাইতেও সুগন্ধি। সাওম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি আনন্দের মুহূর্ত যা তাকে খুশী ও আনন্দিত করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে।[৪]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,

مَنْ صَامَ يَوْمًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بَعَّدَ اللَّهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا

যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে (অর্থাৎ- জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ-এর সময় একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য) সাওম রাখে, আল্লাহ তাআলা তার মুখমণ্ডলকে (অর্থাৎ- তাকে) জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে রাখবেন।[৫]

২য় বৈশিষ্ট্য : জানাযায় উপস্থিত হওয়া

মুসলিম ব্যক্তির জানাযায় উপস্থিত হওয়া তার হকের অন্তর্ভুক্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ : رَدُّ السَّلَامِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدعْوَة وتشميت الْعَاطِس

এক মুসলিমের ওপর আর এক মুসলিমের পাঁচটি হক বর্তায়।

  • ১. সালামের জবাব দেয়া।
  • ২. রোগ হলে দেখতে যাওয়া।
  • ৩. জানাযায় শামিল হওয়া,
  • ৪. দাওয়াত গ্রহণ করা।
  • ৫. হাঁচির জবাব দেয়া।[৬]

জানাযায় উপস্থিত হওয়া এমনই এক ফযিলতপূর্ণ আমল, যার মাধ্যমে বান্দা প্রভূত সাওয়াব লাভ করে থাকে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَنْ شَهِدَ الجَنَازَةَ حَتَّى يُصَلَّى عَلَيْهَا، فَلَهُ قِيراطٌ، وَمَنْ شَهِدَهَا حَتَّى تُدْفَنَ، فَلَهُ قِيرَاطَانِ قِيلَ: وَمَا القِيرَاطانِ ؟ قَالَ : مِثْلُ الجَبَلَيْنِ العَظِيمَيْنِ

যে ব্যক্তি সালাত আদায় পর্যন্ত জানাযায় উপস্থিত থাকবে, তার জন্য এক ‘কিরাত’ সাওয়াব রয়েছে। আর যে ব্যক্তি দাফন করা পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে, তার জন্য দুই ‘কিরাত’ সওয়াব রয়েছে। জিজ্ঞাসা করা হল, দুই কিরাতের পরিমাণ কতটুকু? তিনি বললেন, দুই বড় পাহাড়ের সমান।[৭]

সহিহুল বুখারির বর্ণনায় কথাগুলো এভাবে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَنِ اتَّبَعَ جَنَازَةَ مُسْلِمٍ – إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا – وَكَانَ مَعَهُ حَتَّى يُصَلَّى عَلَيْهَا، وَيَفْرُغَ مِنْ دَفْنِهَا، فَإِنَّهُ يَرْجِعُ مِنَ الْأَجْرِ بِقِيرَاطَيْنِ ؛ كُلُّ قِيرَاطٍ مِثْلُ أُحُدٍ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيْهَا ثُمَّ رَجَعَ قَبْلَ أَنْ تُدْفَنَ فَإِنَّهُ يَرْجِعُ بِقِيرَاطٍ

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে পুণ্যের আশায় কোন মুসলিমের জানাযার অনুগমন করে এবং তার জানাযার সালাত আদায় ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সঙ্গে থাকে, সে দুই কিরাত সওয়াব নিয়ে ফিরবে। প্রতিটি কিরাত হল উহুদ পর্বতের মতো। আর যে ব্যক্তি শুধু তার জানাযার সালাত আদায় করে, তারপর দাফন সম্পন্ন হবার পূর্বেই চলে আসে, সে এক কিরাত সাওয়াব নিয়ে ফিরবে।[৮]

৩য় বৈশিষ্ট্য : মিসকিনদের খাদ্য খাওয়ানো

ইসলাম আমাদেরকে গরিব, দুঃখী, অসহায় ও প্রয়োজন রয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের ব্যাপারে উৎসাহিত করে আবার কখনো কখনো আদেশও করে। এটি আমাদের দ্বীনের অন্যতম সৌন্দর্য।

মিসকিন-অভাবীদের আহার দানের মাধ্যমে বান্দা প্রভূত কল্যাণ লাভ করে থাকে।
কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি ও জাহান্নামের থেকে পরিত্রাণ লাভের অন্যতম আমল হিসেবে আল্লাহ তাআলা যে বিষয়টাকে সাব্যস্ত করেছেন তা হল- খাদ্য খাওয়ানো।
আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلا اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ – وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ – فَكُّ رَقَبَةٍ – أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ – يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ – أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ

তবে সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি। আর কিসে আপনাকে জানাবে—বন্ধুর গিরিপথ কী? তা হচ্ছে ক্রীতদাসকে মুক্তি প্রদান। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্যদান— ইয়াতীম আত্মীয়কে, অথবা দারিদ্র-নিষ্পেষিত নিঃস্বকে।[৯]

আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামীদের ব্যাপারে সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা তাদের জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হিসেবে বলবে,

وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ

আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে খাদ্য দান করতাম না।[১০]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

وَلا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ

আর মিসকীনকে খাদ্যদানে উৎসাহিত করত না।[১১]

গরিব, দুঃখী, অসহায়দের খাদ্য খাওয়ানো জান্নাতে প্রবেশের কারন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِنَّ فِي الْجَنَّةِ غُرَفًا يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا أَعَدَّهَا اللَّهُ لِمَنْ أَلَانَ الْكَلَامَ وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ وَتَابَعَ الصِّيَامَ وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نيام

জান্নাতে এমনসব বালাখানা রয়েছে যার বাইরের জিনিস ভেতর থেকে আর ভেতরের জিনিস বাইরে থেকে দেখা যায়। আর এ বালাখানা আল্লাহ তাআলা ঐসব ব্যক্তির জন্যে তৈরি করে রেখেছেন, যারা অন্য ব্যক্তির সঙ্গে নরম কথা বলে। (অসহায়-মিসকিনকে) খাবার দেয়। প্রায়ই (নফল) সওম পালন করে। রাত্রে এমন সময় (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করে যখন অনেক মানুষ ঘুমিয়ে থাকে।[১২]

বিধবা এবং মিসকীনদের লালন পালনকারী ও তাদের ভরণ-পোষণের জন্য উপার্জনকারী-কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদ ফি-সাবিলিল্লাহ-তে দানকারীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন,

السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالسَّاعِي فِي سَبِيلِ اللَّهِ. وَأَحْسَبُهُ قَالَ: كَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ وَكَالصَّائِمِ لَا يفْطر

বিধবা ও নিঃস্বদের জন্য উপার্জনকারী আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকারীর মতো। বর্ণনাকারী বলেন, আমার ধারণা, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এটাও বলেছেন যে, বিধবা ও নিঃস্বদের জন্য উপার্জনকারী রাতজাগা ইবাদাতকারীর মতো, যে অলসতা করে না এবং ঐ সাওম পালনকারীর মতো, যে কক্ষনো সাওম ভঙ্গ করে না।[১৩]

হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেন। আপনি অসহায়—মিসকিনদের আহার দানে অতি-আগ্রহী হবেন এবং এটা আপনার পক্ষ থেকে আপনার নিজের কল্যাণেই ব্যয় করা হবে। যদি আপনার নিকটাত্মীয়দের মাঝে কোন অসহায় দরিদ্র ব্যক্তি থাকে আর আপনি যদি তাকে দান-সদকা করেন, আর্থিক সহায়তা দেন, খাবার খাওয়ান, তবে এর দ্বারা আপনি সাদাকা ও আত্মীয়তা রক্ষার সাওয়াব লাভ করবেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ

মিসকিনকে সাদাকাহ করলে সাদাকাহর সাওয়াব আর নিকটাত্মীয়ের কাউকে সাদাকাহ করা দুইটা সাওয়াবের কারণ। এক. নিকটাত্মীয়ের হক আদায়ের (সাওয়াব)। দুই. সাদাকাহ করার (সাওয়াব)।[১৪]

হে আমার প্রিয় ভাই! অসহায়-মিসকিনদের ভালবাসুন। নিজেকে তাদেরই একজন মনে করুন। তাদেরকে দান করুন; যদিও সেটা কোন সামান্য জিনিস হয়। তাদেরকে দিতে থাকুন; যদিও সেটা স্বল্পমূল্যের হোক না কেন। আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন। আপনি কখনো নিজেকে তাদের থেকে গুটিয়ে রাখবেন না। আর এটা আমাদের উচিতও হবে না। আপনি লক্ষ্য করুন রাসুলে আরাবির দুআর বাক্যের প্রতি, তিনি আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করছেন,

اللَّهُمَّ أَحْيِنِي مِسْكِينًا وَأَمِتْنِي مِسْكِينًا وَاحْشُرْنِي فِي زُمْرَةِ الْمَسَاكِينِ

হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকিন অবস্থায় জীবিত রাখো, মিসকিন অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং মিসকীনদের দলে হাশর করো।
আয়িশাহ রাদি. জিজ্ঞেস করলেন, কেন হে আল্লাহর রাসুল! তিনি উত্তর দিলেন,

إِنَّهُمْ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ قَبْلَ أَغْنِيَائِهِمْ بِأَرْبَعِينَ خَرِيفًا يَا عَائِشَةُ لَا تَرُدِّي الْمِسْكِينَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ يَا عَائِشَةُ أَحِبِّي الْمَسَاكِينَ وَقَرِّبِيهِمْ فَإِنَّ اللَّهَ يُقَرِّبُكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

তারা ধনীদের চল্লিশ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হে আয়িশাহ! কোন মিসকিনকে তোমার দুয়ার হতে (খালি হাতে) ফিরিয়ে দিও না। খেজুরের একটি টুকরা হলেও প্রদান করো। হে আয়িশাহ! মিসকীনদেরকে ভালোবাসো এবং তাদেরকে নিজের নিকটে রেখো , তাহলে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তোমাকে নিকটে রাখবেন।[১৫]

এখানে উম্মতের জন্য মিসকীনের মর্যাদার শিক্ষা রয়েছে, যাতে মানুষ তাদের সাথে বসে, তাদের ভালোবাসে। আরো রয়েছে মিসকীনদের জন্য সান্ত্বনা ও উঁচু মর্যাদার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা। সাথে সাথে এটাও উদ্দেশ্যে যে, মানুষ যেন তার জীবন নির্বাহের ন্যূনতম উপকরণ ও রসদকেই জীবনের জন্য যথেষ্ট মনে করে। আর সে অঢেল সম্পদ সংগ্রহের পিছনে না পড়ে থাকে। কেননা আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দাদের অধিক সম্পদ জীবনের জন্য ধ্বংস এবং সম্মানের জন্য অমসৃণ উপকরণ।

আয়িশাহ রাদি. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মিসকিন অবস্থার জন্য দুআর কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি তার কারণ বর্ণনা করেন। অর্থাৎ ধনীরা তাদের উত্তম ইবাদত, উত্তম চরিত্রসহ সকল আমলে মিসকিনদের সমকক্ষ হলেও মিসকিনদের চল্লিশ বছর পর জান্নাতে যাবে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়িশাহ রাদি.-কে উপদেশ দিলেন যে, তুমি কখনো কোন মিসকিনকে খালি হাতে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিবে না, অর্ধ টুকরো খেজুর হলেও তাকে দিবে এবং অন্তরে তাদের প্রতি মমতা রাখবে। তাদের নিকটে বসবে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার বিনিময়ে আল্লাহও তোমাকে তার নিকটে স্থান দিবেন।[১৬]

৪র্থ বৈশিষ্ট্য : অসুস্থকে দেখতে যাওয়া

অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, তার সেবা-শুশ্রুষা করা এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব, ইসলাম যার প্রতি আমাদেরকে একান্তভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাসুলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ: رَدُّ السَّلَامِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدعْوَة وتشميت الْعَاطِس

এক মুসলিমের ওপর আর এক মুসলিমের পাঁচটি হক বর্তায়।

  • ১. সালামের জবাব দেয়া।
  • ২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া।
  • ৩. জানাযায় শামিল হওয়া,
  • ৪. দাওয়াত গ্রহণ করা।
  • ৫. হাঁচির জবাব দেয়া।[১৭]

হে আল্লার বান্দা! আপনি কোন অসুস্থ মুসলিম ভাইকে দেখতে গেলেন, কিছু সময় সেখানে ব্যয় করলেন। হয়তো আপনি সেখানে আপনার অতি মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন। তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে যা দিবেন তা এর থেকেও অনেক দামী ও মূল্যবান হবে। আপনি হয়তো বাহ্যিকভাবে কোন অসুস্থ ব্যক্তির পাশে বসে থাকলেও আসলে আপনি জান্নাতের বাগিচায় বসে আছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسلم لم يزل فِي خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ

কোন মুসলিম তার অসুস্থ কোন মুসলিম ভাইকে দেখার জন্য যখন চলতে থাকে, সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ‘খুরফার’ মধ্যে সর্বদা অবস্থান করে।। জিজ্ঞাসা করা হল, হে আল্লাহর রাসুল! ‘খুরফাহ’ কী? তিনি বললেন,জান্নাতের আহরিত ফল।[১৮]

যখন আপনি কোন অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রূষায় যান, তখন সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত ৭০ হাজার মালাক আপনার জন্য মাগফিরাত ও রহমতের দুআ করতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَا مِنْ مُسْلِم يَعُودُ مُسْلِماً غُدْوةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُمْسِي، وَإِنْ عَادَهُ عَشِيَّةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُصْبحَ، وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ في الْجَنَّةِ

যে মুসলিম সকাল বেলায় কোন অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে যায়, তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার মালাক দুআ করতে থাকে। যদি সে তাকে সন্ধ্যায় দেখতে যায়, তার জন্য সত্তর হাজার মালাক সকাল পর্যন্ত দুআ করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরি হয়।[১৯]

রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন,

إِن الله عز وَجل يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِي قَالَ: يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ قَالَ: أَمَّا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ؟ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِي عِنْدَهُ؟ يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِي قَالَ: يَا رَبِّ كَيْفَ أُطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِي فُلَانٌ فَلَمْ تُطْعِمْهُ؟ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي؟ يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِي قَالَ: يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ قَالَ: اسْتَسْقَاكَ عَبْدِي فُلَانٌ فَلَمْ تَسْقِهِ أما إِنَّك لَو سقيته لوجدت ذَلِك عِنْدِي

আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বলবেন, হে বানী আদম! আমি অসুস্থ ছিলাম। তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে যাব? আপনি তো বিশ্বজাহানের রব! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, আমাকে অবশ্যই তার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি আপনাকে কিভাবে খাবার দিতাম? আপনি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল? তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, সে সময় যদি তুমি তাকে খাবার দিতে তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে? হে বানী আদম! আমি তোমার কাছে পিপাসা নিবারণের জন্য পানি চেয়েছিলাম। তুমি পানি দিয়ে তখন আমার পিপাসা নিবারণ করোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি কিভাবে আপনার পিপাসা নিবারণ করতাম? আপনি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তখন তাকে পানি দাওনি। যদি তুমি সে সময় তাকে পানি দিতে, তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে।[২০]

অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় কিছু বিষয় :

  • ১. উপযুক্ত সময় নির্ধারণ।
  • ২. রোগীর সুস্থতার জন্য দুআ করা।
    আয়িশাহ রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا اشْتَكَى مِنَّا إِنْسَانٌ مَسَحَهُ بِيَمِينِهِ ثُمَّ قَالَ : أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ وَاشْفِ أَنْتَ الشَّافِي لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ شِفَاءٌ لَا يُغَادِرُ سَقَمًا

আমাদের কারো অসুখ হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ডান হাত রোগীর গায়ে বুলিয়ে দিয়ে বলতেন, হে মানুষের রব! এ ব্যক্তির রোগ দূর করে দিন। তাকে নিরাময় করে দিন। নিরাময় করার মালিক আপনিই। আপনার নিরাময় ছাড়া আর কোন নিরাময় নেই। এমন নিরাময় যা কোন রোগকে বাকী রাখে না।[২১]

  • ৩. বিপদ আপদে ধৈর্য ধারনের ফযিলত স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
  • ৪. সুস্থতার ব্যাপারে তাকে হতাশ না করা। বরং আল্লাহর রহমতে দ্রুত সুস্থতার ব্যাপারে আগাম সুসংবাদ দেওয়া, যদিও তার রোগ মারাত্মক পর্যায়ে যাক না কেন।

যাইহোক, এ ছিল সেই চারটা বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে আলোচনা, যে চারটা বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির মাঝে একত্রিত হলে সে জান্নাতিদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

হে আমার প্রিয় ভাই!
→ একই দিনে এই চারটি বৈশিষ্ট্যে নিজেকে মন্ডিত করা কি বেশি কঠিনসাধ্য ব্যাপার?
→ এ কাজগুলো কি অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে করা সম্ভব নয়?
→ আমরা কি খাদ্য খাওয়ানোর জন্য দিনে একজন মিসকিন পাইনা?
→একটি জানাজা কি পাইনা, যাতে আমরা শরিক হবো?
→দৈনিক একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া কি আমাদের পক্ষে অসম্ভব?
→আল্লাহ তাআলা যদি আমাকে সুস্থতার নিআমত দান করেন, তাহলে সাওম পালন করা কি আমার জন্য খুব বেশি কষ্ট সাধ্য?

এটা আল্লাহ তাআলার মহাঅনুগ্রহ- যা দ্বারা তিনি আমাদের ধন্য করেছেন। সুতরাং আপনি যদি সে সকল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা সুস্থতার নিয়ামত দিয়েছেন এবং সেইসাথে সুযোগও দিয়েছেন, তাহলে আপনার কর্তব্য হবে সাওম রাখা, মিসকিন-অসহায়দের আহার দান করা। যদি আপনি তাদেরকে না খুঁজে পান, তাহলে অসহায়দের আহার দান করে এমন কোন সংস্থার সহায়তা নেওয়া। আপনার অবস্থান যদি কোনো বড় শহরে হয়ে থাকে, তাহলে আপনি সেখানে এমন মসজিদ বা স্থান খুঁজে পাবেন, যেখানে জানাযার সালাতের ব্যাপারে সাধারণের মাঝে প্রসিদ্ধি রয়েছে। এমন স্থানে যেয়ে জানাযায় শরিক হওয়া উচিত।

হে প্রিয় ভাই! আমাদের উচিত হবে আশেপাশে যে সকল হাসপাতাল বা ক্লিনিক রয়েছে, সেখানে যাওয়া এবং রোগীদের চিকিৎসা সহায়তায় পাশে দাঁড়ানো। এর মাধ্যমে আমরা সুস্থতার নিয়ামত অনুভব করতে পারবো। অন্তর থেকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারবো। ফলে আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি তার নিআমতকে বাড়িয়ে দিবেন।

আল্লাহ তাআলা কল্যাণকর কাজে আমাদেরকে অগ্রগামী হওয়ার তাওফিক দান করেন। আমিন।

আবদুল্লাহ আল মামুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *